
ভোরের আলো
কলমে – ভারতী ভট্টাচার্যী
ভোরের আলোয় সমুদ্র সৈকতে বসে আকাশটাকে দেখতে কি অপূর্ব লাগে ! মনে হয় আকাশ–সমুদ্র একসাথে মিলে–মিশে একাকার হয়ে গেছে ! সমুদ্র সৈকত সর্বদাই মনোময় | সৈকতের শেষান্ত থেকে ছোট–বড়ো হৃদয় ছোঁয়া ঢেউ গুলো সোঁ সোঁ শব্দ করে সৈকতে আছড়ে পরে সব ধুয়ে–মুছে ঝকঝকে করে দিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে | দেখে মনটা শান্ত হয়ে যায় | সুমিতা অনুভব করে সমুদ্র নিজেকে অশান্ত রেখে সবার মন শান্ত করছে | তবে কি সেটা সমুদ্রের কান্না ? সংসারের এতো নোংরা,মানব–মানবীর এতো কষ্ট বইতে নিশ্চয় খুব কষ্ট হচ্ছে সমুদ্রের ! তবু বয়ে যেতে হচ্ছে | নিজের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত সুমিতা সমুদ্রের বুকে নিজেকে সঁপে দিতে এসেছিল কিন্তু পারলো না! সমুদ্রের সীমাহীন কষ্টের কাছে সুমিতা হার মানতে বাধ্য হলো | অনেকক্ষণ একান্তে সমুদ্রের কাছে বসলো এবং সমুদ্রের কষ্টের পরিসীমা নিরীক্ষণ করতে পেরে অবশেষে বুঝতে পারলো তার কষ্ট কত ক্ষুদ্র | অবশেষে মনকে শক্ত করে নিজের গন্তব্যে রওনা দিলো |
সুমিতা কাক ভোরে বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে | মা ছাড়া ঘরে আর থাকতে পারছে না সে | বাবার কাছ থেকে মা দূরে চলে যাবার পর ধীরে ধীরে সুমিতা বুঝতে পারে সংসারের প্রতি মায়ের অবদান | নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে আজ | মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে সোজা রেল স্টেশন পৌঁছে একটি ট্রেনে উঠে বসলো | সৌভাগ্য ক্রমে টিটিই কে বলে একটা বসার জায়গাও জুটিয়ে ফেললো। অনেক ভেবে সুমিতা মায়ের কাছে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে | এবং বাবার সাথে সম্পর্ক শেষ করার আগে ট্রেনে বসেই একখানা চিঠি লিখলো বাবাকে —
প্রিয়
বাবা তুমি হয়তো ভাবছো তোমায় আজ আমি কেন চিঠি লিখছি ! যাবার আগে তোমায় বলে আসতে পারতাম | কিন্তু আমি জানি যে কথা গুলো তোমায় আজ আমি বলতে চাই,তা তোমার চোখে চোখ রেখে বলতে পারতাম না | তুমি আমার জন্য আর অপেক্ষা করো না | আমি মায়ের কাছে চলে যাচ্ছি | তুমি চেয়েছিলে আমি তোমার কাছেই থাকি,এবং আমি জানি তোমার কাছে থাকলে আমার ভবিষৎ অনেক উজ্জ্বল হবে কিন্তু স্বার্থপর হতে পারলাম না | আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে মা কিন্তু আমায় কোনোদিন ওঁর কাছে থাকতে বলেন নি | কিন্তু এক নারী হয়ে অন্য এক নারীর ব্যথা বুঝতে না পারার গ্লানি আমায় আজকাল অহরহ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে বাবা | তুমি কিন্তু আমার শৈশব ও বাল্যকাল এর প্রয়োজন মেটাতে কোনো গাফিলতি করোনি কিন্তু অন্যদিকে সেটাও সত্যি,মা কে তুমি কোনো দিন সুখ দাও নি | আমি তোমার আদরে প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি | এখন বুঝতে পারি মাকে অবহেলা করা তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছিলো |
আমার মনে পড়ে,মা কত রবিবার তোমার সাথে বাইরে যাবার জন্য বায়না করতো কিন্তু আমার একমাত্র অবিবাহিতা চাকুরীরত পিসির জন্য তুমি মাকে একা কোথাও নিয়ে যেতে না | পাছে পিসির খারাপ লাগে | মা খুব সিনেমা দেখতে ভালোবাসতো কিন্তু তুমি বাসতে না,তাই মা কোনোদিন একটা ও সিনেমা দেখতে পারেনি | মায়ের খুব ইচ্ছে থাকতো তুমি ছুটির দিন বাইরে কোনো হোটেলে খাওয়াবে এরপর একটু এদিক–ওদিক ঘুরে বাড়ি আসবে | অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল মায়ের,তাই কিশোরী মেয়ের মতো ছোট ছোট কিছু ইচ্ছা ছিল তার | কিন্তু তোমার বাবা–মায়ের সেবাতে ব্যাঘাত ঘটবে বলে তুমি কোনোদিন নিয়ে যাওনি মাকে | একবছরের মধ্যে ই আমার জন্ম হয়ে যাওয়ায় আমাকে বড়ো করার দায়িত্ব মায়ের উপর বর্তালো | কারণ তুমি তো অফিস করেই ক্লান্ত ঘরের অন্য সদস্যের আমার প্রতি দায় না থাকলেও তোমার তো ছিল | কিন্তু অন্যদের মতো তুমিও মাকে কোনো সাহায্য করোনি | ঠাম্মা কে অনেকদিন তোমার সামনে মাকে বলতে শুনেছি,তোমাকে যেন কোনো কাজের কথা বলা না হয়,কারণ তুমি টাকা রোজগার করে না আনলে আমাদের চব্যচোষ্য খাওয়া জুটবে না | মা যে এতো ভালো শাড়ি পরে,সেসব সম্ভব হতো না | তুমি তখন কোনো প্রতিবাদ করোনি উল্টে পোশাক পাল্টে মায়ের বিছানায় চুপ করে শুয়ে থাকতে | এখন বুঝতে পেরে সব শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে | তোমার মতো আমিও সমানভাবে মায়ের কাছে অপরাধী |
জানো বাবা আমি খেলার মাঠ থেকে ফিরে এসে মাঝে মাঝে দেখতাম মা ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে গান করতে করতে কাঁদছে | ভাবতাম নারায়ণের প্রতি আবেগে–ভক্তিতে হয়তো নয়নের বারি ঝরছে | তখন কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি | আমার মনে আছে তুমি এল টি সি তে চার বছরে একবার সবাই কে নিয়ে বেড়াতে যেতে | তুমি কিন্তু কোনোদিন হোটেলে ওঠোনি | পাছে তোমার বাবা–মায়ের কষ্ট হয়,তুমি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে | আমার মা সবার জন্য রান্না করতো | কারণ তোমার বাবা–মা বাইরে খাবেন না | সকাল থেকে কাজ করে ক্লান্ত–পরিশ্রান্ত মা আমার সন্ধ্যাবেলা বাইরে বেড়াতে যেতে চাইতো না কিন্তু তোমরা মা কে নানা কথায় জর্জরিত করে যেতে বাধ্য করতে | আমি ও ভাবতাম মা ঘরে মিছেমিছি অশান্তি করে সবার আনন্দটা তেতো করে দিচ্ছে | চলে গেলেই তো পারে | এখন বুঝি মায়ের প্রতি কতটা অন্যায় হয়েছে |
মনে আছে বাবা, মা একদিন তোমার জন্মদিনে একটু একটু করে পয়সা জমিয়ে ভালোবেসে একটা ঘড়ি কিনেছিলো , কিন্তু তোমার জন্মদিনে তোমাকে ঘড়িটি উপহার দিতেই তুমি প্রশ্ন করলে,মা এতো টাকা কোথায় পেয়েছে | নিশ্চয় পকেট থেকে টাকা চুরি করে কিনেছে | তোমার কথায় মা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল | সবার সামনে ঠাম্মাও সে নিয়ে অনেক কথা শোনালেন , পরে তুমি জিজ্ঞেস করে বুঝতে পেরেছিলে মা নিজের ভাইফোঁটাতে পাওয়া টাকা দিয়ে ঘড়িটা কিনেছে এবং সে নিয়ে ক্ষমাও চেয়েছিলে কিন্তু মায়ের সেই মুহূর্তের কষ্ট কি তুমি কোনোদিনও লাঘব করতে পেরেছিলে ? মা কোনোদিন আর কারো জন্য কিছু কিনে আনেনি | তোমার স্মরণে আছে কি না জানি না বাবা,মায়ের দাদা–বৌদি একদিন এসে সবার সামনে মায়ের খুব সমালোচনা করছিলো,মা ছেলেমানুষি করে,পাগলামি করে,কোনো কাজে মন নেই,ছটফটে ইত্যাদি ইত্যাদি | তুমি শুনে হাসছিলে | কিন্তু বাবা তোমার তখন কি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করা উচিত ছিল না ? কারণ তোমার কাছে আসার পর মায়ের কোনো কাজে এমন কোনো স্বভাবের কি ছায়া দেখেছো ? দেখোনি ! হতে পারে মা ছোটবেলায় এমন ছিল ,কিন্তু তুমি যা পাও নি সেটা নিয়ে তোমার ব্যঙ্গ করার কোনো অধিকার আছেকি ? নিজের জীবনে যুদ্ধ করতে করতে জর্জরিত মা যখন একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরিতে ঢুকলো তখনো তুমি মার পাশে এসে দাঁড়ালে না ! সেদিন মা আর কারো দিকে না তাকিয়ে নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে দূরে চলে গেলো | তুমি আটকালে না মাকে! আমিও তখন মায়ের পাশে দাঁড়াই নি | প্রচন্ড অপমান করেছো মাকে | কর্তব্য আর দায়িত্ব এর টানাপোড়নে বুঝতে পারছিলাম না মায়ের সিদ্ধান্তটা নেওয়া উচিত হয়েছিল কিনা? আমার নিজের মান–সম্মান সেই মুহূর্তে সব থেকে প্রধান বলে মনে হয়েছে | কি করে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো | সবাই মাকে নিয়ে প্রশ্ন করলে কি জবাব দেবো? কেন মা সব ছেড়ে বাইরে চলে গেলো | কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত আমি কি করবো ! তোমার তো মা–বাবা–দিদি আছেন | আমার মায়ের যে আমি ছাড়া কেউ নেই বাবা | পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও | তোমার ঋণ না হয় কোনো না কোনোদিন শোধ করে দেবো কিন্তু মায়ের দুধের ঋণ যে জন্ম জন্মান্তরে ও শোধ করতে পারবো না | শুধু মায়ের পাশে থেকে একটু শান্তি দেবার চেষ্টা তো করতে পারি | ভালো থেকো বাবা |
ইতি
তোমার
সুমিতা …….|
******************************
ভারতী ভট্টাচার্য পরিচিতিঃ ভারতী ভট্টাচার্য একজন ব্যবসায়ীক মহিলা এবং লেখক। বর্তমানে বাসস্থান অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম শহরে।