স্ব–অন্বেষণ
পিয়ালী ভট্টাচার্য্য
কবিগুরুর কথায়, “যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা, নয়নে আঁধার রবে ধেয়ানে আলোকরেখা“। এই আলোক রেখার পথ ধরে আমাদের পৌঁছতে হবে লক্ষ কোটি চন্দ্রপ্রভা স্নিগ্ধ আলোর উৎসে, আলোকের ঝর্ণাধারায় সিঞ্চিত হতে। এই যে পরিক্রমা, তাতে দুটি সত্ত্বা বিদ্যমান। প্রথমতঃ আমি, দ্বিতীয়তঃ আলোকবর্তিকা রূপী সত্ত্বা। আর যাত্রাপথ হলো ভিন্ন ভিন্ন। ঠাকুর বলেছেন, “যতো মত, তত পথ“। বিভিন্ন পথেই আমরা যেতে পারি আলোর খোঁজে। তবে শুধু অনুকরণ করলেই চলবে না, গভীর বোধের সাথে অনুসন্ধিৎসু হয়েই সত্যের পথের অনুসরণ আমাদের করতে হবে।
পথের ঠিকানা পাবার আগে পূর্বোল্লিখিত দুটি সত্ত্বা সম্পর্কে বিশেষ জানা প্রয়োজন। প্রথম সত্ত্বা হলো, আমি। আমি কে? আমি বলতে প্রথমেই আসে নামরূপ ধারী এক প্রাণসত্ত্বা।এখন এই মানুষ আমি বলতে আমার নাম, শরীর, পরিচয়, রূপ ইত্যাদি প্রাধান্য পায়। সেটা কিন্তু প্রকৃত আমি নয়, এরা সবই আমার এবং আপেক্ষিক। তাহলে আরো সূক্ষ্মভাবে যদি ভাবি, তবে মন, আবেগ, বিবেক, বুদ্ধি এগুলো আমি নয় ,আমার সংস্কারযুক্ত প্রতিভূ, বা আমার প্রতিচ্ছায়া। প্রাণবায়ু / আত্মারাম যখন শরীররূপী খাঁচার বাইরে চলে যায়, তখন সবকিছুই পড়ে থাকে অস্তিত্বহীন ভাবে। তাই, আমি হলো সেই প্রাণবায়ু বা আত্মসূর্য, যার দেখা মেলে সংস্কারমুক্ত মানসচক্ষে, যখন চর্মচক্ষু আঁধার ও ধেয়ানে মানসচক্ষু আলোক সুধা পান করে। আমি হলো সেই ঈশ্বরীয় সত্ত্বার–ই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ, যার মধ্যে তার স্রষ্টার গুণগতমান একশত শতাংশ বিদ্যমান। অর্থাৎ, আমার মধ্যেই ঈশ্বরীয় সত্ত্বার পূর্ণ প্রকাশ। আমি আর ঈশ্বর অভিন্ন – সৃষ্টির শুরুতে এই আমি ছিলাম, আজও আমি সেই আমিই আছি। তবে, একটা প্রভেদ আছে। একটি কেরোসিনের বাতি অনেকক্ষণ জ্বললে যেমন তার কাঁচের ভেতরের দেওয়ালে কালি জমতে জমতে পুরু হয়ে যায় ও বাইরে থেকে আলো অস্পষ্ট জ্বলতে দেখা যায়, আমাদের বর্তমান অবস্থায়ও তাই। যদি আবার কাঁচটি পরিষ্কার করে লাগানো যায়, তবে দেখা যাবে বাতিটি পুনরায় আগের মতোই তার নিজস্ব দীপ্তিতে জাজ্জ্বল্যমান। সৃষ্টির শুরুতে আমি ও ঈশ্বর ছিলাম সমমানের। যখনই জন্ম–মৃত্যুর আবর্তে আবদ্ধ হলাম তখনই আমি আমার কর্ম ও তার অবশ্যম্ভাবী ফলের ঘেরাটোপে পড়ে গিয়ে নতুন নতুন সংস্কারের সৃষ্টি করতে করতে আমার দেদীপ্যমান সত্ত্বার চারিদিকে সংস্কারের পুরু স্তর তৈরি করে ফেললাম ও করে চলেছি আ–বিবর্তিত কাল ধরে।
এখন কেউ যদি আমরা ভাবি যে, আমি আমার সমস্ত কর্মফল শুধু ভোগ করেই এই জন্ম মৃত্যু থেকে মুক্তি লাভ করবো, নতুন কোনো কর্ম করবোনা, নতুন কর্ম না করলে ফল ভোগের প্রশ্ন নেই। তাহলে যদি স্থবির হয়ে জড়ভরতের মতো বসে থাকি তাতেই মুক্তিলাভ হবে; বিলম্বিত হলেও। তবে বলবো, এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, কর্ম কথাটি স্থূল অর্থেই শুধু প্রযোজ্য নয়, সূক্ষ্ম অর্থে কর্ম হলো চিন্তা। অর্থাৎ, আমি যে চিন্তা করছি, তার ফলই আমাকে নতুন নতুন সংস্কারে বাঁধছে। অতএব, এ চেষ্টা পুরো–ই বৃথা। কর্ম ও কর্মফল, জন্ম ও মৃত্যুর বৃত্ত থেকে বাইরে বেরোতে গেলে চিন্তারহিত হতে হবে, মনকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে, সেটি অত সহজ কাজ নয়। কারণ, দ্রুতগামী ও সর্বাপেক্ষা চঞ্চল হল মন, যাকে নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যন্ত কঠিন কাজ।
আধ্যাত্মবাদে বিভিন্ন পন্থার মধ্যে যোগ হলো একটি পন্থা। সব পথেই গন্তব্যে পৌঁছানো যায় নিশ্চয়ই, তবে বিজ্ঞানসম্মত ও অপেক্ষাকৃত সহজ পন্থা হলো যোগ। এই যোগেরও আবার বিভিন্নতা রয়েছে। রাজযোগ, ক্রিয়াযোগ, হঠযোগ ইত্যাদি সবই আধ্যাত্মবাদের সহায়ক। তবে, আমি মনে করি রাজযোগ ও ক্রিয়াযোগের সমন্বয় সাধন ঘটাতে পারলে প্রক্রিয়াটি অনেক আরামদায়ক ও সহজ হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো ঈশ্বর সৃষ্ট মানুষের জন্যই এই পন্থা। মানবসৃষ্ট মানুষের জন্য অর্থাৎ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য এগুলি অন্তরায় নয়, এগুলি সর্বজনীন।
চিন্তারহিত অবস্থায় আসতে গেলে রাজযোগ ও ক্রিয়াযোগের নির্দিষ্ট বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় সেটির প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন মানব দেহ।চুরাশি লক্ষ যোনি অতিক্রম করে মানবজন্ম লাভ হয়। ফলতঃই এতো জন্মের সংস্কার ও তার ভোগ যোগ–বিয়োগ এর মাধ্যমে আমরা বর্তমান যে অবস্থায় আছি তাতে ক্রিয়াযোগ বিশেষ করে আমাদের নতুন সংস্কার গঠনে বাধা দেয় ও পুরানো সংস্কারের অবসান ঘটিয়ে মুক্ত করে। সেই আদি পূর্ণবিকশিত সত্ত্বার দর্শন/আত্মদর্শন ঘটায় ও নিজেকে পরমাত্মার স্তরে উন্নীত ক’রে আধ্যাত্মিকতার চরম শিখরে উন্নীত করে। কথাতেই আছে, “মানুষই দেবতা হয়, হয় অবতার“। ঈশ্বর, দেবতা, অবতার, মানুষ – এগুলি একই সত্ত্বার সংস্কারভেদে বিভিন্ন পদপ্রাপ্তি। অর্থাৎ, মানুষ তার আত্মিক উন্নয়নের মাধ্যমে ও তার পূর্ণতার প্রকাশের মাধ্যমে অবতার–যথা, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, শ্রী রামকৃষ্ণদেব, রামপ্রসাদ, শ্যামাচরণ লাহিড়ী ইত্যাদি। দেবতা – যথা, দূর্গা, কালী, শিব, কৃষ্ণ, লক্ষী, স্বরস্বতী, গণেশ ইত্যাদি; এবং ঈশ্বর–তথা পরমাত্মাতে উন্নীত হতে পারে এটাই মানব জীবনের পরম লক্ষ্য।
এখন, প্রশ্ন হতে পারে দেবতা ও ঈশ্বর সমার্থক? সেক্ষেত্রে বলি, ঈশ্বর বা পরমাত্মা হলো নামরূপহীন নিরাকার ব্রহ্ম। ব্রহ্ম হলো নিশ্চল, স্থির, প্রাণময় ঈশ্বরীয় সত্ত্বা। তারই একধাপ নেমেই দেবতা। কারণ, তারা নাম, রূপ ও আকারবিশিষ্ট। নিশ্চল, স্থির ব্রহ্ম যখন বিন্দুমাত্র স্পন্দিত হয়ে ওঠে, তখনই তাঁর লীলা শুরু হয়ে দেবতায় পর্যবসিত হন। আর, বিভিন্ন দেবতাগণও ধ্যানমগ্ন থাকেন। তাঁরাও কিন্তু সেই পরমাত্মার ধ্যানেই মগ্ন, কারণ সেটাই চরম স্থিরাবস্থা বা শিবাবস্থা। সমাধিস্থ হওয়াই হলো সকল আত্মার চরম লক্ষ্য, যেখানে অনুভূতিহীন ভাবে একাত্ম হওয়া যায়, নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায়। এখানেই স্ব–অন্বেষণের সমাপ্তি ঘটে।
পিয়ালী ভট্টাচার্য্য পরিচিতি :
১৯৮৩ সালের ২২–শে ডিসেম্বর, মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের এক পন্ডিত বংশে পিয়ালীর জন্ম। বাবা পীযুষকান্তি ভট্টাচার্য্য পেশায় শিক্ষক, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। মা লক্ষ্মী দেবী গৃহবধূ। তিন ভাইবোনের কনিষ্ঠতমা পিয়ালী শৈশব থেকেই বাবার আধ্যাত্মিকতার সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠায় আধ্যাত্মবাদের প্রতি অনুরক্ত, যে আনুরক্তি যৌবনে এসে পূর্ণতা পেয়েছে। বর্তমানে পিয়ালী একটি উচ্চবিদ্যালয়ে ইংরাজী–র শিক্ষিকা এবং সাহিত্যের প্রতি পরম অনুরাগ ছাড়াও পিতার ভাবাদর্শে প্রাণিত হওয়ার সুবাদে আধ্যাত্মবাদ ও আধ্যাত্মসাহিত্যের অনুরাগী।
আমার ‘আমি’কে চেনা, হৃদপিণ্ডের প্রতিটি ধ্বনিকে অনুভব করা, আত্মিকচেতনায় যে বিপুল তরঙ্গ প্রবাহিত হয় সেই তরঙ্গকে অনুভবে দেখে জগৎ মাঝে তা দেখতে পাওয়া এ এক মহা বিস্ময়কর জিনিস। মাতৃগর্ভে জ্যোতিষ্কলোকের এক আলোক বিন্দুই প্রাণ রূপে সঞ্চারিত হয়। আমাদের দেহে যা যা আছে তা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকলের সম্মিলন। আর তার মূল হলো ক্রোমোজোম। যার মধ্যে বিদ্যমান এই বিশ্বজগতের সকলকিছুর মূল শক্তি আদি অনাদি কালের সকল অনুভব। তাই-ই মানুষকে চেতনার গভীরে নিয়ে যায়। আসে সৃষ্টি, আসে আনন্দ। এ এক মহাবিস্ময়কর অনুরণন অন্তর মাঝে। আমার কাছে মনে হয় আত্মিক চেতনাবোই আধ্যাত্মিকতা। চন্দ্র, সূর্য্য, গ্রহ, তারা, ফুল, পাখি, সবুজ পাতা, আলো, বাতাস, অন্ধকার, মাটি, জল, মেঘ, বৃষ্টি সব কিছুতেই কেমন যেন এই বোধকে খুঁজে পাই। তোমার লেখা পড়ে আমিও নিজেতে হারিয়ে গেলাম। নিজের অনুভব কে নির্বিচারে বলে ফেললাম। খুব ভালো লিখেছো। খুব ভালো থেকো সৃষ্টিতে। সুস্থ্য থেকো।
দাদা আপনার যে ভালো লেগেছে এটা আমার পরম প্রাপ্তি। আপনার বিশ্লেষণ ও অনুভব মন ছুয়ে গেল। আপনি খুব ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।চেতনায় থাকুন।। আপনি খুব উন্নত মানসিকতার লোক সেটা আমি আগেই বুঝতে পেরেছি।। আশীর্বাদ করবেন যেন এই বোধ কে পাথেয় করে জীবন পথে চলতে পারি।।