প্রতারক
মনি ফকির
নমস্কার।আমি অগ্নি।পেশায় ডোম।চমকে গেলেন? ঠিকই পড়েছেন। পেশাদারি নয়।কারণ উপার্জনের অন্য রাস্তা আছে আমার। মানুষের দহনে আমি সহায়তা করি।আমার ভালো লাগে।
জীবনের গল্প গুলোকে যদি একটি নাটকের মত ভিন্ন অধ্যায়ে ভাঙা হয়, একেকটা অঙ্ক বলা যায়।আমার গল্প গুলোকে আমি দহনে ভাঙলাম।
আমাদের একটি পারিবারিক দহন কুঞ্জ রয়েছে। যারা দাহ হতে আসে, তাদের সবার মৃত্যুর কারণ,ইতিহাস আমি লিখে রাখি।বলতে পারেন এটা আমার হবি।আসুন।
দহন–১
ঐ যে দূরে যিনি পুড়ছেন,তার নাম অবিনশ্বর মিত্র।একদা ব্যাঙ্কের কর্মী। উপার্জন খুবই অল্প।কারো বুদ্ধিতে যোগ দিলেন একটি চিট ফান্ড সংস্থায়। অবস্থা ফিরে গেল।ফুলে ফেঁপে ওঠেন অবিনশ্বর।তারপর একদিন তার সংস্থাটি ডুবে যায়,সাথে বহু মানুষের সঞ্চয়। অনুতপ্ত অবিনাশ যখন বুঝতে পারলেন যে মানুষ আর এ টাকা ফেরত পাবেনা; তখন নিজের সকল সঞ্চয় ভেঙে,জমি জমা বিক্রি করে কিছু মানুষের টাকা ফেরত দিলেন।কিন্তু যেদিন খবর পেলেন স্কুলের ভাস্কর স্যার ক্যান্সার এর চিকিৎসা করাতে না পেরে মৃত্যু শয্যায়, সেদিন রাতেই তিনি বিষ খেলেন। ভাস্কর স্যার তার সব সঞ্চয়, প্রিয় ছাত্রের কথায় ইনভেস্ট করেছিলেন।
ইনি একজন প্রতারক।
দহন–২
নৈঋত কোনে নদীর ধারে আগুনে পুড়ছে হৈমন্তী।গানবাজনা পাগল মেয়ের এই নাম রাখেন বাবা মা।একদিন হৈমন্তীর জীবনে বসন্ত এল। ফাগুনের রঙ লাগল মনে।
কিন্তু সে রঙ চিরস্থায়ী হলো না।
তারপর একদিন, কোনো অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়,বিষকণ্যা হয়ে গেল সে। নিছক অকারণেই যৌবনের অদম্য নেশায়, কুহকিনী। তারপর একদিন এক বিলাসবহুল নিভৃত ঘরের দরজা খুলে তার প্রেমিকের মুখ দেখে চমকে উঠল সে। নিষাদ, নিষাদ..তুমি.…..।
তার কয়েক দিন পর,গঙ্গার ঘাটে নিথর হৈমন্তীর শরীর পাওয়া যায়।
এও একজন প্রতারক।
দহন –৩
ঐ বট গাছ তলায় পুড়ছেন অনির্বাণ।এনার গল্পটি খুবই সংক্ষিপ্ত ও সাধারণ। নিতান্ত আটপৌরে অবস্থাপন্ন জীবন যাপন এ অভ্যস্ত মানুষটির জীবনে প্রথম প্রেম এল, বিবাহিত জীবনের কুড়ি বছর পর। প্রথমে সঙ্কোচে লজ্জা পেয়েছিলেন। পরে মনের ডাকে সাড়া দেন। জীবনে মানুষ যা যা পেতে চায় তার সবই ছিল। পেশাগত ভাবে সফল একজন সংসারী পুরুষের চল্লিশোর্ধ্ব প্রেমের অপরাধ সমাজ ক্ষমা করেনা।অনির্বাণ কাউকে বোঝাতে পারেননি তিনি তার ‘কোপাই‘ কে কতখানি ভালোবাসেন। আদর করে এই নামেই ডাকতেন। তাকেও সে অকারণ দারুন ভালোবাসত। বাড়িতে ঘৃণার দৃষ্টি, পরিচিত মহলে পরিহাস।মাথা নীচু করে অপরাধীর মত বেঁচে থাকা,সবকিছু মেনে নিয়েছিলেন অনির্বাণ।
কিন্তু যেদিন কোপাই তাকে অবিশ্বাস করল, নিতে পারলেন না। রাস্তা পে্রোতে গিয়ে একদিন…।
অনেকেই বলে সুইসাইড। যাই হোক, একজন মানুষ শুধু উজাড় হয়ে ভালবেসে হারিয়ে গেলেন।
ইনিও একজন প্রতারক।
দহন –৪
মন্দিরের পাশে যে আগুন জ্বলছে তার তত্ত্বাবধানে রয়েছে বহ্নি। আমার মেয়ে। এক ঝড় বাদলের রাতে ও পড়েছিল,রক্তাক্ত,অচৈতন্য। তখন থেকেই ও আমার মানসকন্যা।এই দহন কুঞ্জটি সদ্য প্রজ্জ্বলিত। আমি এর গল্প জানি না। কাছে গিয়ে দেখতে হবে। অনেক সময় বহ্নি লিখে রাখে।
কাছে গিয়ে দেখি কোনো দেহ নেই ঐ চিতায়।আমার অবাক হবার পালা। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘কিরে এখানে কাকে দাহ করা হচ্ছে?’
বহ্নি উত্তর দেওয়ার আগেই পাশ থেকে ভেসে এল ফকির বাবার কণ্ঠস্বর “এই দহন বেদী আমার“।
ফকির বাবার আসল নাম জানা যায়নি।কেউ কেউ বলেন ফকরুদ্দিন, কেউ বলেন ফারুক।সবাই ফকির বাবা বলেই ডাকে।জনান্তরে ফক্কর বাবা। উনি এরকম মাঝে মধ্যে উদয় হন।এখানে একরাত থাকেন, তারপর কাউকে কিছু না বলে হাওয়া।
আমি বললাম,তুমি তো আমার পাশে স্বশরীরে।
-“তো কেয়া হুয়া,ইয়ে আগ ম্যায়নে লাগায়া।বেটি কো মালুম নহি।বুঝলি বেটা ঐ চিতায় আমার সব প্রতারণা জ্বলছে। যত বেইমানি আমি নিজের সাথে করেছি সব। যত ভাবের ঘরে চুরি করেছি সব।
–ম্যায় ভি এক ঠগওয়া হুঁ।
আমিও একজন প্রতারক।”
শান্তির জল।
—————————————————————————–
রাত এখন গভীরতম।
অবিনশ্বর এখনো নিশ্চিন্তে নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছেন।
হৈমন্তী শহরের কোনো পানশালায় জীবনের নেশায় মাতাল।
অনির্বাণ বারান্দায় চুপ করে বসে মালকোষ শুনছেন।
আর ফকির বাবা আমার পাশে বসে বহ্নির সাথে বকবক করছে।
আসলে এরা সত্যি করে কেউই মরেনি।হয়তো সত্যিই মরে গেছে। নশ্বর দেহটা জীবিত শুধু।অন্তরের মানুষ টা পুড়ছে।
—————————————————————————–
আমাদের এই দহন কুঞ্জ, শহরের কোথাও আপনারা খুঁজে পাবেন না। এখানে শুধুমাত্র প্রতারকদের পোড়ানো হয়। একটা ব্যক্তিগত নদীর তীরে এর অবস্থান। এর খোঁজ শুধুমাত্র তারাই পায়,যারা প্রতারক,যাদের শরীর হেঁটে চলে বেড়ায়, মন বহুযুগ আগে মৃত। আমার কাজ এদের দহন আয়োজন করা।
আমি চিরকাল থাকবোনা।বহ্নি কে সব শিখিয়ে দিয়েছি।
আজ আসি।বহ্নি ডাকছে।ফকির বাবা আর আমার মেয়ে মিলে গরমগরম রুটি আর বেগুন পোড়া বানাচ্ছে।খুব খিদে পেয়েছে সবার।।
—————————————————————————-
মণি ফকিরের জন্ম শিল্পনগরী বার্ণপুরে। সাহিত চর্চার অভ্যাস ছাত্র জীবন থেকেই। অনুপ্রেরণা মা ও মামার কাছ থেকে। প্রথম কবিতার বই *মণি ফকিরের পদাবলী* প্রকাশিত হয় ২০১৮ পূজোয়। গল্পকারের মূল বৈশিষ্ট্য তার গল্প বোনার ও বলার সাবলীল ধরন। গল্পের শেষে কিছু না বলা কথার প্রচ্ছন্ন ঈঙ্গিত মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।।
বেশ সুচারু চিন্তাভাবনা। পাঠক কে গল্পের শেষে আবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে নিজেকে নিয়ে ভেবে দেখার জন্য।
কিন্তু, তি তি করে?
এই না বলা হতাশার আত্মরতিজ প্রাপ্তি সময়ের কুহকিনী তমিশ্রার ফাঁদে না পড়া… সময় এলেই অথবা পেলেই কি জীবন মুচকি হেসে মুখ ফেরাবে প্রতারক??
গল্প বলার ধরনটা ভালো লাগলো। বেশ অন্যরকম।