
মাতৃরূপেণ
তিতিলা মুখার্জি
আজ চতুর্থী ।মায়া একটা চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে আছে। ওদের বাড়ির প্রায় উল্টো দিকে একটা বড়ো পুজো হয়। প্রত্যেক বছর নানান পুরস্কার পায়। আজকাল তো আবার এমনি পুজো না,সব থিম এর পুজো। এ বছরের পুজো শেষ হতে হতেই মিটিং হয়ে যায়,পরের বছর কি থিম,কে ঠাকুর বানাবে। এ ধরনের নাম করা পুজোতে ঠাকুর বানায় যারা তারাও তো খুব বিখ্যাত একেকজন।
প্যান্ডেল এর কাজ শুরু হয়ে যায় তিন মাস আগে থেকেই। ভেতরে কি হচ্ছে যেন দেখা না যায় চারদিক ঢাকা। মায়া তাও অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে আসতো কি হচ্ছে কাণ্ড টা। নিজেই বাড়ি এসে হাসে নিজের ছেলেমানুষী দেখে ।
নিজের ছোটবেলাটা মনে পড়ে যায়। মায়ার স্কুল জীবন কেটেছে ভবানীপুরে। ওখানেই তো তখন কত নাম করা পুজো আশেপাশে। বাড়ির কাছের পুজো বলতে মহুয়া ক্লাব । ওখানে স্কুল থেকে ফেরার সময় যেদিন প্রথম দেখতো বাঁশ এনে রেখেছে,মন টা ভালো হয়ে যেতো। কি আনন্দ। সে কিন্তু এই মাস খানেক আগে হতো,এতদিন আগে নয়। রোজ ফেরার পথে দেখা প্যান্ডেল কতটা হলো । ঠাকুর আসতো দ্বিতীয়া বা তৃতীয়া তে। মুখ ঢাকা থাকতো। সেও এক অপেক্ষা কবে মায়ের মুখ দেখা যাবে। কবে আশেপাশে সেই ঝালমুড়ি,ফুচকা, ঘুগনি সব পাওয়া যাবে। প্যান্ডেল এ যাওয়া মানেই সারা বছর যা যা খাওয়া বারণ সব খাওয়া। এখন তো মহালয়া থেকেই ঠাকুর দেখা শুরু হয়ে যায়। রাস্তায় চলার উপায় নেই। সেই দিন গুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল।
আজ মায়া বাড়িতে একা । ছেলে বাইরে ছুটি পায় নি,বিকাশ গেছে বন্ধুর বাড়ি। মনটা আবার রাস্তায় নিয়ে এলো। বাব্বা কত লোক আজকেই বেরিয়ে পড়েছে। সবাই ভাবে চতুর্থী,রাস্তা খালি থাকবে। ব্যাস আরো ভিড়।
ছোট ছোট সব ছেলে মেয়ে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েছে। ওদের হাসি গল্পের আওয়াজে রাস্তা সরগরম। ওদের সাজ পোশাক দেখলেই মায়ার রাগ হয়। কি যে সব পরে বেরিয়ে পড়েছে। ওদের সময় ভাবাই যেতো না। জন্মদিন আর পুজো,বছরে দুটো জামা বাবা মা কিনে দিত। একটা জুতো। আর মাসি পিসি যা কিনে দিত। মাথায় তেল দিয়ে বিনুনি। তেল মাখবো না বলার উপায় ছিল না।
আর এখন অনলাইনে শপিং আর মল গুলোর কল্যাণে এদের সারা বছর এটা চাই ওটা চাই। শুধু জামা না সঙ্গে আবার কি যেন এরা বলে অ্যাকসেসরিজ,মিলিয়ে মিলিয়ে পরবে। চুলে কত রকম রঙ। উফফ্। তাই তো এরা শুধু নিজেদেরটা বোঝে। নিজেদের হয়ে গেলে হয়ে গেল। আর কোনো কিছু ভাবার দরকার নেই।
সত্যি। দূর দূর! এদের দেখে কোনো কাজ নেই। তার থেকে টিভি তে সিনেমা দেখলে কাজ দেবে।
উঠতে যাচ্ছিল,হঠাৎ চোখ চলে গেল ওদের বাড়ির নিচে একটা গাড়ির দিকে। ওরকম আধুনিক পোশাক পরা দুটি মেয়ে তাদের ঠাকুমা বা দিদিমা কে হাত ধরে গাড়ি থেকে নামাচ্ছে। ওনার স্পোর্টস শু পরা যাতে চলতে অসুবিধা না হয়। একজন নেমে জুতোটা ঠিক করে দিলো। দুই নাতনি দুদিকে হাত ধরে ধীরে ধীরে ওঁকে নিয়ে চলেছে মণ্ডপের দিকে প্রতিমা দর্শনের জন্যে। কি মমতার সঙ্গে সাবধানে ওই মহিলাকে নিয়ে যাচ্ছে ওরা । চোখের আড়াল হওয়া পর্যন্ত ওদের দেখলো মায়া।
ইসস্! কি যেন ভাবছিল মায়া,নতুন প্রজন্ম খুব স্বার্থপর। নিজেদেরটা বোঝে। কই এরাও তো আজকের প্রজন্ম। কতো মায়া এদের। কতো ভালবাসা । ওদের মধ্যেও তো মায়ের রূপ দেখতে পেলো মায়া,অকারণে বিচার করতে শুরু করেছিল। সেরকম সময় এলে এরাও মা হয়ে যায়,যতই আধুনিক পোশাক পরুক । চোখ বন্ধ করে মায়া নিজের মনেই বললো,
– ওদের ভালো রেখো মা,সবাই কে ভালো রেখো।
*********************************
তিতিলা মুখার্জী ~ কলকাতাতেই জন্ম ও বড় হওয়া । কর্ম জীবন থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার পর সাহিত্য,গান,কবিতা নিয়ে পথ চলা
খুব ভালো লাগলো তিতিলা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো সত্যি তো।খুব দরকার সবারই।