
ভুল
সুজয় দত্ত
চোঙা করে পাকানো খবরের কাগজটা বারান্দার চাতালের বদলে গিয়ে পড়ল সামনের এক চিলতে বাগানের নরম কাদায়। ছুঁড়তে গিয়ে লক্ষ্যে ভুল হয়েছে কাগজওয়ালার। এ–বাড়ির কাজের লোকটি গেট দিয়ে ঢুকে বারান্দায় ওঠার আগে কাদামাখা কাগজটা দেখে গজগজ করতে করতে তুলে নিয়ে গেল ভেতরে। এমনিতেই আসতে দেরি হয়েছে তার। রোজ ভোরবেলা উঠে লোকাল ট্রেনের ঠাসাঠাসি ভিড়ে এতটা পথ আসে। আজ তাড়াহুড়োয় সোনারপুর লাইনের বদলে ভুল করে বজবজ লাইনের গাড়িতে উঠে পড়েছিল। আবার একটা অচেনা স্টেশনে নেমে উল্টোদিকে ফিরতে হল, তাই এত দেরি ।
বাড়ীর বুড়োকত্তা অবশ্য দেরিতে আসা বা নোংরা কাগজ — কোনটা নিয়েই কিছু বললেন না। শুধু বারান্দায় এতো ঘেউঘেউ করে কুকুর ডাকছে কেন, জিজ্ঞেস করলেন বিরক্তমুখে। আসলে কাজের লোকটি ঢোকার সময় বাগানের গেটটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে, তাই ফাঁক পেয়ে ভেতরে সেঁধিয়েছে হতচ্ছাড়ারা। অগত্যা তাকেই গিয়ে আবার তাড়িয়ে আসতে হল। গেট–টেট বন্ধ করে ঘরে ঢুকেই নজরে পড়ে তার — কত্তার বিছানার পাশের টেবিলে জলভর্তি গ্লাসটা যেমনকার তেমন রয়েছে প্লেট ঢাকা দেওয়া। তার মানে নিশ্চয়ই কাল রাতে শোবার আগে ওষুধগুলো খেতে ভুলেছেন। শরীরে রোগের ত্রিবেণীসঙ্গম তাঁর — হার্টের ব্যামো, গাঁটের ব্যামো আর পেটের ব্যামোতে মাঝেমাঝেই শয্যাশায়ী থাকেন। হার্টের রুগী এই কয়েক বছর যাবৎ, কিন্তু পেটের গন্ডগোল আর গাঁটের ব্যথা বহুযুগের পুরোনো। প্রথম প্রথম গোঁ ছিল হোমিওপ্যাথি–কবিরাজী ছাড়া দেখাবেন না। তারপর তাদের ভুল চিকিৎসায় অবস্থা খারাপের দিকে গড়াচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারের গাদা গাদা বড়ি গেলা শুরু করলেন যখন, ততদিনে বেশ একটু দেরিই হয়ে গেছে। এখন উঠতে ওষুধ, বসতে ওষুধ, শুতে ওষুধ।
কিন্তু ওগুলো ঠিকসময়ে খাওয়ার কথা মনে থাকলে তো ! কাজের লোক দুবেলা কাজ করে দিয়ে যাওয়া ছাড়া বাড়িতে লোক বলতে আসে এক রাঁধুনী। বাজার–টাজারও সেই করে। তার বয়ে গেছে মনিবের শরীরস্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে। এসে তাড়াহুড়ো করে বাজার নামিয়ে কোনোরকমে রান্নাটুকু সারলেই তার কম্মো শেষ। আর কাজের যা ছিরি সে তো কহতব্য নয়। চাল আনতে গিয়ে ভুল করে ডাল নিয়ে আসছে, ময়দার শিশিতে ব্যাসন ঢেলে ফেলছে, মাছ কিনতে গিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে আনার কথা বেমালুম মাথা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বুড়োকত্তা এমনিতে খুব একটা কিছু বলেননা এসবের জন্য। কিন্তু গত রোববার সে টমেটোর অম্বলে চিনির বদলে ভুলে নুন ঢেলে ফেলায় খেতে বসে যখন মনিব থু–থু করে ফেলে দিলেন, তখন স্বীকার করা বা লজ্জা পাওয়া তো দূরস্থান, উল্টে তাঁকে “বুড়োবয়সে মুখে অরুচি হয়, সবকিছু ওরকম নোনতা লাগে” বলে হাত-পা নেড়ে জ্ঞান দিতে এলে উনি এক ধমক দিয়েছিলেন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে গোঁসা, পরদিন থেকে কামাই। আবার কদিন বাদে কাজের লোকটাকে পাঠিয়ে বিস্তর অনুরোধ উপরোধ করে ফিরিয়ে আনতে হল তাকে।
অতএব আজ যখন সে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ঢুকে সশব্দে বাজারের থলিটা ফেলেই বলল “এই যাঃ, পাঁচফোড়ন আনতে ভুলে গেছি। যাকগে, আজকের দিনটা জিরে-ধনে-হলুদ দিয়ে চালিয়ে নেব’খন”, কত্তা মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন। শুধু কাজের লোকটাকে চুপিচুপি বলে রাখলেন ও রান্না করার সময় একটু নজর রাখতে, যাতে কিছুতেই বেশি নুন না দিয়ে ফেলে। হাজার হলেও হার্টের রুগি তো — ডাক্তারের কড়া নিষেধ। নজর সে রেখেছিল ঠিকই , কিন্তু রাখতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যে কান্ডটা করল তাতে ভালর চেয়ে মন্দ হল বেশী। ভুল করে কাপড়জামা-ডোবানো বালতিতে কাপড়কাচা সাবানের বদলে বাসনমাজা সোডা দিয়ে ফেলল। কত্তার ফতুয়া, বালিশের ওয়াড় আর বিছানার চাদরের রং জ্বলে গিয়ে একাকার কান্ড।
যাইহোক, সারা সকাল এইসব গন্ডগোল চলতে থাকায় কত্তা অন্যদিন একটু বেলার দিকে যে এককাপ গরম দুধ খান, সেটাই আজ খাওয়া হল না। ফুটন্ত গরম দুধ খেতে পারেন না বলে তাড়াতাড়ি ঠান্ডা করার জন্য অল্পক্ষণ ফ্রিজে রাখা তাঁর স্বভাব। আজ উত্তেজিত হয়ে ভুল করে ডিপফ্রিজারে রেখে ফেলায় অনেকক্ষণ বাদে যখন খেয়াল হল, দেখলেন সে–দুধ আইসক্রীম হয়ে গেছে। তারপর দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে যে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শোবেন, তার জো আছে? আরেক নতুন বিপত্তি। আজ মাসের শেষ, কাজের লোকটা যাবার সময় মুখ কাঁচুমাঁচু করে মাইনে চাইছিল। তাকে তখন দাবড়ানি দিয়ে “আঃ, যা তো এখন, বিকেলে নিবি” বললেন বটে, কিন্তু টাকা যে থাকে স্টিলের আলমারীর মধ্যে। তার চাবি কোথায়? বিছানার তোষকের তলায় থাকার কথা, কিন্তু নেই তো! ভুলে কোথায় রেখেছেন কিছুতেই মনে পড়ছে না। অতএব খোঁজ খোঁজ। শেষে আলনায় ঝোলানো ফতুয়ার পকেট থেকে বেরোলো সেটা।
অবেলায় দিবানিদ্রা আচমকা ভেঙে গেল কাজের লোকের কড়া নাড়ার শব্দে। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেই খেয়াল হল তাঁর পাশের ঘরে অকারণে সিলিং ফ্যানটা বনবন করে ঘুরছে — দুপুরে ঘর মোছা হয়েছিল যখন, মেঝেতে জল–জল ছিল বলে ফ্যান চালিয়ে শুকোতে দিয়েছিলেন, ঘুমোতে যাওয়ার আগে বন্ধ করতে ভুলে গেছেন। শুধু শুধু কারেন্ট পুড়ল এতক্ষণ ধরে। কাজের লোক কাজটাজ শেষ করে মাইনে নিয়ে সবে গেটের বাইরে পা বাড়িয়েছে, ঠাকুরঘরে তালমিছরির শিশিটা আনতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল কত্তার — ধূপকাঠি ফুরিয়েছে, দেশলাইটাও স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে অকেজো, হাজার ঘষেও জ্বালাতে পারেননি কাল। সন্ধ্যেবেলা ঠাকুরকে ধূপ দিতে পারবেন না এখুনি আনিয়ে না রাখলে। সকালে রাঁধুনিটা বাজার যাওয়ার সময় বলতে ভুলে গেছেন ওকে। অতএব আবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাগানের গেটের কাছে গিয়ে “অ্যাই গোবিন্দ, অ্যাই গোবিন্দ” বলে চীৎকার করতে গিয়ে দেখলেন গোবিন্দ ততক্ষণে বড়রাস্তার বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছে, তার কানে আর পৌঁছবে না।
সেই সন্ধ্যেয় কত্তার শরীরটা কেমন যেন আনচান আনচান করে উঠল। বুকের বাঁদিকটা টান ধরেছে, অদ্ভুত একটা ব্যথা কাঁধ থেকে হাতে নেমে আসছে ক্রমশঃ, সারা দেহে কিরকম একটা অস্বস্তি। কই, অন্যদিন তো এমন হয়না — দিব্যি টিভি খুলে সিরিয়ালের পর সিরিয়াল দেখেন। কী হল কে জানে আজ ! আসলে তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন যে মাসে মাসে ডাক্তার চেকআপ–এর সময় ঠিক এই লক্ষণগুলোর কথাই বারবার আউড়ে তাঁকে সাবধান করেন ডাক্তারবাবু। বলেন এগুলো হলেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে লোক ডাকতে, দেরি করলে জীবন নিয়ে টানাটানি হবে। কিন্তু আজ যদি সেকথা মনে পড়তও কত্তার, চট করে লোক ডাকতে পারতেন না। কারণ পাড়ার পরিচিত করিৎকর্মা ছেলেছোকরাদের — এই যেমন হাবুল, সমীর, বাপী, শিবু, রতন — মোবাইল নম্বরগুলো একসঙ্গে লেখা ছিল যে পুরনো ডায়রীটায়, সেটা কোথায় রাখা আছে তাই তো ভুলে মেরে দিয়েছেন। ফলে রাত বাড়তে লাগল আর তার সঙ্গে একলা বাড়িতে তাঁর অসহায় ছটফটানিও।
পরদিন সকালে কান্নার রোল উঠল সেই পাড়ায়। প্রতিবেশীরা সব গম্ভীর মুখে জটলা করে দাঁড়িয়ে গেটের সামনে। কেউ খাট–ফুল–মালার ব্যবস্থা করছে, কেউ শববাহী গাড়ীকে খবর দিচ্ছে, কেউ আবার কিছুই না করে শুধু মাতব্বরী দেখাচ্ছে। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট লিখে বেরিয়ে গেলেন একসময়। না না, আমাদের সেই কত্তার নয়। অন্য একজনের। ঠিক উল্টোদিকের দোতলা বাড়ীর সধবা বুড়িটার। বয়স সত্তর ছোঁয়নি, কোনো অসুখেও ভুগছিল না, হঠাৎ কী করে মারা গেল কে জানে। আসলে হয়েছে কী, যমরাজ গতরাতে কত্তাকেই নিতে এসেছিলেন। কিন্তু একটুর জন্য ঠিকানা ভুল করে উল্টোদিকের বাড়ির সেই মহিলাকে তুলে নিয়ে চলে যান। ভুল কি কেবল মানুষই করে?
****************************
সুজয় দত্ত বর্তমানে আমেরিকার ওহায়ো রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানতত্ত্বের (statistics) অধ্যাপক। তিনি কলকাতার বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ছাত্র। তরুণ বয়স থেকেই সাহিত্য তাঁর সৃজনশীলতার মূল প্রকাশমাধ্যম,সাহিত্য তাঁর মনের আরাম। ছোটগল্প, বড় গল্প, প্রবন্ধ ও রম্যরচনার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতাও লেখেন তিনি। এছাড়া করেছেন বহু অনুবাদ–হিন্দি থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে। তিনি হিউস্টনের “প্রবাস বন্ধু” ও সিনসিনাটির “দুকুল” পত্রিকার সম্পাদনা ও সহসম্পাদনার কাজও করেছেন। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘বাতায়ন’ পত্রিকাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এই পত্রিকাগুলি ছাড়াও ‘অপার বাংলা’ ও ‘গল্পপাঠ’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিন দুটিতে,নিউজার্সির ‘আনন্দলিপি’ ও ‘অভিব্যক্তি’ পত্রিকা দুটিতে,কানাডা থেকে প্রকাশিত ‘ধাবমান’ পত্রিকায়,ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত পূজাসংকলন ‘মা তোর মুখের বাণী’ তে,ভারতের মুম্বাই থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা পরবাসে’ রয়েছে তাঁর লেখা। কলকাতার প্রসিদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজসেবী সংস্থা ‘পোয়েট্স ফাউন্ডেশন’-এর তিনি অন্যতম সদস্য। সম্প্রতি নিউ জার্সির “আনন্দ মন্দির” তাঁকে “গায়ত্রী গামার্স স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে” সম্মানিত করেছে। সাহিত্যরচনা ছাড়া অন্যান্য নেশা বই পড়া, দেশবিদেশের যন্ত্রসঙ্গীত শোনা এবং কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো।