
কচুশাক
সাথী সেনগুপ্ত
সুলগ্না ফ্রিজ পরিষ্কার করছিল । মানার মা ঘর ঝাঁট দিয়ে, বালতিতে ন্যাতা ভিজিয়ে মোছার জোগাড় করছিল। সুলগ্না ফ্রিজ থেকে একগাদা কৌটো বার করেছে। তাতে অনেক পুরনো খাবার জমে আছে । সেগুলো খুলে খুলে , গন্ধ শুঁকে ময়লা ফেলার বালতিতে ফেলছিল সে। মানার মা ঘর মুছতে মুছতে মনে মনে ভাবল – ‘বাবাঃ, বউদিরা কত খাবার নষ্ট করে। সময়মত খেয়ে নিলে বা ওকে দিয়ে দিলেও তো পারে।’
সুলগ্না বলল, ‘তুমি শোবার ঘর দুটো আগে মুছে নাও। তারপর এদিকে এসো।’
এ কৌটো ও কৌটো খুলতে খুলতে একটা কৌটোয় ভেজে রাখা ইলিশ মাছের মাথাটা পেল সুলগ্না। দুদিন আগে ইলিশ মাছ রান্না হয়েছিল। তখনই বাণীকে দিয়ে মাথাটা ভাজিয়ে রেখেছিল । পুঁইশাক , চালকুমড়ো ইত্যাদির সঙ্গে ইলিশের মাথা দিয়ে কাঁটা চচ্চড়ি বা ঘণ্ট বেশ লাগে সুলগ্নার। কিন্তু মুশকিল হল কাঁটা চিবোবার সময় কোথায় ? রোজই তাড়াহুড়ো করে অফিস ছুটতে হয়। আর বিপ্লব এসব কাঁটা চচ্চড়ি খেতে পছন্দই করেনা। একা একা কি এসব খাওয়া যায়? আজ শনিবার । অফিস ছুটি। তাইতেই ফ্রিজ পরিষ্কারে লেগেছে সে। নাঃ আর কত জমিয়ে রাখবে? কি মনে করে মানার মা কে ডাকে সুলগ্না। – ‘ শোন , ইলিশের মাথাটা ভাজা রয়েছে , তুমি বরং নিয়ে যাও। কোন সবজিতে দিয়ে খেয়ে নিও।’
মানার মা খুশি হয়। এ বছর ইলিশের খুব দাম। তেমনই দাম আনাজপাতির। কিছুতে হাত ছোঁয়াবার উপায় নেই । গেল বছর ‘আন্না’পুজোয় ঘরে ইলিশ এসেছিল। এ বছর বোধ হয় তাও পারবে না। মেয়েটা পোয়াতি। কদিন হল মায়ের কাছে আছে । মুখে একদম রুচি নেই । সেও ভাল মন্দ কিছুই খেতে দিতে পারেনা । এখন মাসের শেষ দিক। পাশের বাড়ির বউদির কাছ থেকে আগাম টাকা চেয়ে নিয়ে গতকালই চাল , আলু কিনেছে। ভেবেছিল ফেরার পথে দু টুকরো মাছ কিনে নিয়ে যাবে। রোজ রোজ সেদ্ধ ভাত কার বা ভাল লাগে। আজ মাছ না হোক মাছের মাথাটা রান্নায় দিলে মাছের গন্ধ মেখে দু গাল ভাত খাবে মেয়েটা ।
কাজ সেরে বউদির দেওয়া সাদা পেলাস্টিকের কৌটোটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। পথে বাজার পড়ে। এক শাকবেচুনি মাসি বসে আছে কিছু কচুশাক নিয়ে । আহা, এ যে মেঘ না চাইতেই জল। ইলিশ মাছের মাথা আর কচুর শাক – এ যে একেবারে নতুন বিয়েওলা মেয়ে মদ্দর মিল। মাথার ওপর রোদ্দুর চড় চড় করছে। ভাদ্দর মাসের রোদ।
শাকবেচুনি মাসি শাক কটা বেচে উঠি উঠি করছে । মানার মা সামান্য পয়সায় নিয়ে নেয় শাকগুলো । – ‘ কি গো, ভাল জায়গা থেকে তুলেছিলে তো শাক গুলো ?’
‘কি যে বল, তার ঠিক নেই কো! সক্কাল বেলা বাবুরা কত’ কটি কিনে নে গেল। শেষ বেলার ক খানা তুমি নে যাও ।’
খুশি মনে পয়সা দিয়ে শাকগুলো তুলে নেয় মানার মা।
বাড়ি এসে ভাত বসায়। ঘস ঘস করে শাক কেটে ভাল ভাবে ধুয়ে নেয়। মেয়ে এই সমস্ত আয়োজন দেখে খুব খুশি। ভাত নামিয়ে গামলির মধ্যে হাঁড়ি উপুড় করে মাড় গালে । তারপরে ইস্টোভে কড়াই বসিয়ে মনের মত করে কচুশাক রাঁধে।
মেয়ে বলে – ‘কি ভাল বাস দেচ্ছে গো মা ! গন্ধেই খিদে পেয়ে যাচ্ছে ! ’
‘আহা, শুধু খিদে পেলে চলবে? ঝুপ্পুস করে চ্যান করে আয় না ।’
মানা রাস্তার কলতলায় নাইটির ওপর গায়ে গামছা দিয়ে চান করতে যায় । খালপাড় বস্তির আরও দু চারজন মহিলা কলতলায় জুটেছে। মিনতি মাসি ধুপধুপিয়ে এক গাদা কাপড় কাচছে। কাপড় আছড়াবার সঙ্গে সঙ্গে রাশি রাশি সাবানের ফেনা কলতলা বেয়ে নালি দিয়ে বেরোচ্ছে। পৃথুলা চেহারার বিন্তির মা সায়া ব্লাউজ পরে বালতিতে জল নিয়ে ঝুপ ঝুপ করে গায়ে জল ঢালছে। ভেজা শরীরে সায়া ব্লাউজের মধ্য থেকে বুক ,পাছা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কর্পোরেশনের কল থেকে মোটা ধারায় জল পড়ছে। কলের তলায় একটা বালতি বসানো। মানা গিয়ে এক ধার ঘেঁসে বালতি হাতে দাঁড়াল। ‘বিন্তির মা গায়ে জল ঢালতে ঢালতে বলল –‘কিরে মানা, মায়ের কাছে এয়েছিস ? ক মাসের হল?” মানা মাথা নামিয়ে বলে ,‘পাঁচ মাস হল কাকিমা।’ ‘সাবধানে থাকিস মা।’
মাথা নাড়ে মানা। ভেজা কলতলায় কোনরকমে জল গায়ে ঢেলে ঘরে ঢুকবে সে। এদিকে মিনতি মাসির কাপড় কাচা জল ছিটকে লাগে বিন্তির মায়ের গায়ে। বিন্তির মা চেঁচিয়ে ওঠে , খিস্তি করে মিনতি মাসির উদ্দেশ্যে । ব্যাস, দুজনে লেগে গেল তুমুল কেত্তন। মানা হাঁ করে দুজনকে দেখতে গিয়ে পা পড়ল সাবানে পেছল কলতলায় । দুজনের ঝগড়া থেমে গেল ‘গেল গেল’ রব তুলে। কলতলায় লম্বা হয়ে পড়ে থাকা মানাকে তুলতে গিয়ে দেখে সাবান জলের সঙ্গে রক্তের ধারা ছুটেছে। মানার পা বেয়ে নেমেছে রক্ত।
ইতিমধ্যে খবর গেছে মানার মায়ের কাছে । বস্তিরই কেউ গিয়ে খবর দিয়েছে – ‘ও মাসি দেখগে যাও তোমার মেয়ের কি কাণ্ড ঘটেছে।’ পড়ি মরি ছুটল মানার মা। মিনতি মাসির উদ্দেশ্যে অভিশাপ আর গালি দিতে দিতে, রক্ত মাখা নাইটি পরা ক্রন্দনরতা মানাকে নিয়ে ছুটল সরকারি হাসপাতালে। বস্তির আরও দু একজন গেল সঙ্গে। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু দেখে শুনে বললেন –‘এ তো রাখা যাবেনা।’ বিকেলের মধ্যেই সবকিছু পরিষ্কার করে দেওয়া হল। মানার শ্বশুরবাড়ি থেকে শাশুড়ি , ননদ এল। তারা নানা রকম কথা শোনাল মানার মা কে। সন্ধের পরে আচ্ছন্নতা কিছুটা কাটলে রিক্সা করে ঘরে এল বিধ্বস্ত মা ,মেয়ে। খিদেও পেয়েছে খুব ।
ঘরে ঢুকে মানার মা দেখল ভাতের হাঁড়ি উলটে পড়ে আছে । আর কচুশাকের বাসনটা চেটে পুটে খেয়ে বস্তির ছোঁচা হুলো বেড়ালটা মুখ চাটতে চাটতে বেরিয়ে গেল ।
******************************
সাথী সেনগুপ্ত পরিচিতি:
প্রায় দু দশকের ওপর ছোটগল্প লিখছেন। প্রকাশিত হয়েছে দেশ,সাপ্তাহিক বর্তমান,উনিশ কুড়ি,ফেমিনা বাংলা,তথ্যকেন্দ্র,আনন্দমেলা,সন্দেশ,শুকতারা প্রভৃতি বিখ্যাত বানিজ্যিক পত্রিকায় এবং বিভিন্ন অবানিজ্যিক ছোট পত্রিকায়। প্রকাশিত গল্প সংকলন দুটি। সুহা এবং গুপি চোরের কান্ড। ব্যক্তিগত জীবনে শিক্ষকতা করেন। শখ-আবৃত্তি চর্চা,বইপড়া,ভ্রমণ এবং অবশ্যই লেখালেখি।