অভিশপ্ত রাগিনী(প্রথম পর্ব)
রামানুজ দাশগুপ্ত
ওরা ছিল চারজন। ধরে নেওয়া যাক রাম-শ্যাম-যদু-মধু কারণ ওদের আসল নাম গুলোর অস্তিত্ব আজ আর নেই। অনেকদিন আগেই ধুয়ে মুছে গেছে।ওরা মিলেছিল শেষ পর্যন্ত একই জায়গায় যেমনটা হয়েছিল গুপী আর বাঘার।গুপী বাঘার গানবাজনা সবার কাছে কর্ণ পীড়াদায়ক ছিল তাই সমাজের লোক তাদের বের করে দিয়েছিল, তারপর ভূতের রাজার বর ও বাকি কথা তো সবারই জানা কিন্তু রাম শ্যাম যদুর গান-বাজনা তো একদিন ঘরে ঘরে সোনালী আলোর আবেশ তৈরি করত। তা সত্বেও সমাজ তাদের বার করে দিয়েছে। আজ কোথায় তারা? হয়তো বর্তমানকালের ইউ-টিউব সার্চ করলে তাদের দু চার খানা গান পাওয়া গেলেও যেতে পারে কিন্তু এখনকার কোন সঙ্গীতপ্রেমী কি তাদের মনে রেখেছে না তাদের নিয়ে আলোচনা করে থাকে! ওরা বেঁচে আছে কি মরে গেছে দু-চারজন ছাড়া কেউ জানেনা এই চারজনের মধ্যে ডঃ শম্ভুনাথ মিশ্র একজন যিনি। দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতার এক মানসিক হাসপাতালে বদলি হয়ে এসেছেন।প্রথম দিন ডিউটিতে এসে দেখেন একজন রোগী বয়স বেশি নয় তিরিশের এর মধ্যেই হবে, প্রায় সবসময়ই দেওয়ালে কান লাগিয়ে কি যেন শোনার চেষ্টা করে। তার অধীনে যেসব রোগীরা ছিল এই রোগীটি তার মধ্যে ছিল না। কিন্তু কৌতূহলবশত একদিন ডঃ মিশ্র জিজ্ঞাসা করে বসেন, “কি শুনছো তুমি?” পাগল মুখে তর্জনী লাগিয়ে ইশারা করে, চুপ,কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। হিংস্র নজরে ডাক্তারকে দেখে তারপর প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে ,তারপর ভাঙা ও কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে বলে, “আমার গলার সুর তুমি কেড়ে নিয়েছো। লজ্জা করেনা জিজ্ঞাসা করতে- শুনে রাখো ওই দেওয়ালের মধ্যে আমার হারিয়ে যাওয়া গানকে আমি শুনতে পাই। যদি আমার সাথে শত্রুতা না করতে, তবে তুমিও শুনতে পেতে”।ডাক্তার মিশ্র সেখান থেকে সরে আসেন ডাক্তারের কেন জানিনা মনে হল এই ছেলেটি বোধহয় ভাল গায়ক ছিল। তিনি নিজেও একজন সঙ্গী প্রেমিক তার উৎসাহটা খুব বেড়ে গেল। ডাক্তার রায় এর আন্ডারে এই রোগীটি ছিল। তার কাছে কেস হিস্ট্রি টা জানতে চাইলেন ডাক্তার রায় বেশ কিছুটা সিনিয়ার। সেই কারণেই বোধহয় একটু ইগো প্রবলেম ছিল,তাই তিনি রাজি হলেন না কেস হিস্ট্রি দিতে।
রবি একজন ভালো তবলা বাজিয়ে অনেক নামী শিল্পীদের সাথে স্টেজে ও রেকর্ডিংয়ে বাজায়। ডঃ মিশ্র কয়েকদিন আগেই এক ঘরোয়া আসরে একজন বিশিষ্ট শিল্পীর সাথে সঙ্গত করতে দেখেছেন এবং মুগ্ধ হয়েছেন। একদিন রাতে ডিউটি চলাকালীন হঠাৎ একটি দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেলেন।
সেই পাগলটি প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে গেছে, “আমার গান কোথায় হারিয়ে গেছে তাকে খুঁজে এনে দাও” ।এই বলে ভাঙা গলায় প্রচণ্ড চিৎকার করছে, কয়েকজন ওয়ার্ডবয় তার হাত-পা চেপে ধরে আছে এবং একজন নার্স তাকে ইঞ্জেকশন দিতে যাচ্ছে। এই ওয়ার্ডবয়দের মধ্যে একজনকে দেখে খুব চেনা লাগলো্ এবং কয়েক সেকেন্ড লাগলো চিনে নিতে। আরে এত তবলা বাজিয়ে রবি!একি করে সম্ভব! পাগল শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরলো ডাক্তার মিত্র রবিকে ডেকে পাঠালেন. তুমি এখানে ওয়ার্ডবয়ের কাজ করো তুমি না একজন ভালো তবলা বাজিয়ে !রবি একটু হাসির চেষ্টা করল সে হাসির মধ্যে কোন প্রাণ নেই। আজ দীর্ঘদিন ধরে সে হাসি-কান্নার জগত থেকে বাইরে, তার কোনো ভাবাবেগ সেরকম ভাবে কেউ দেখেনি, যবে থেকে সে এখানে কাজ করতে এসেছে।
তবে পাগলরা ক্ষেপে গেলে তখন তার অন্য চেহারা। গলা খুলে কাঁচা খিস্তি দেয়, দরকার পড়লে তাদের মারধরও করে। স্ত্রীর হার্টের গুরুতর অসুখ একদম শয্যাশায়ী জলের মতো টাকা খরচ হয়, দুই মেয়ে। তাদের পেছনেও অনেক খরচা। শুধু তবলা বাজিয়ে সে পয়সা একত্র করা যায় না ।বাবার সংসারের অবস্থাও ভাল ছিল না, অল্প বয়সে বাবা চলে যান ।ক্লাস এইট এর বেশি পড়া হয়নি সুতরাং এই কাজটাই ভবিতব্য ছিল এবং সে তা করে চলেছে একনিষ্ঠভাবে। ডাক্তার মিশ্রের দিকে তাকিয়ে জবাব দেন আপনি দেখেছেন আমাকে, তবে জেনে রাখুন গত কুড়ি বছর ধরে এই কাজ করে আসছি আর ছাড়তে পারিনি বাকিটা জেনে আপনার কোন লাভ নেই । নমস্কার। আর কিছু না বলে অন্য দিকে চলে যায়। ডাক্তারের কৌতূহল আরও বেড়ে চলে।
ওদিকে মধ্য কলকাতার এক বনেদি বাড়ির ছেলে দিব্যপ্রেম। সবাই জানত খুব ভালো সুরকার ।গোটা দুয়েক ছবিতে সুরও দিয়েছিল ,নাম হচ্ছিল, তবে তখনও তেমন করে পয়সার মুখ দেখেনি। বাড়ির ছাদটা আর যৌথ পরিবারের খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতোই মিলতো। মাকে ছেলেবেলাতেই হারিয়েছে হঠাৎ করে বাবা মাস দুয়েক আগে গত হলেন। বাড়িতে তিন দাদা আর বৌদি। বাবা মারা যাবার পর থেকেই তারা কেমন যেন অদ্ভূত আচরণ শুরু । বছর দুয়েক আগে অনিরুদ্ধর লেখা গান, তার সুরে রঙ্গনাথ মুখার্জীর গলায় কলকাতা তথা সারা বাংলার আকাশ বাতাস ভরিয়ে দিয়েছিল।এরপর ভালো সুযোগ পেয়ে মুম্বাই চলে যায় সেখানে গিয়ে ও সফলতার প্রাথমিক মুখ দেখেছিল। দিব্য আর অনিরুদ্ধ চায়নি রঙ্গনাথ চলে যাক ।সে চলে যাওয়াতে তাদের টিমওয়ার্কটা বেশ ঢিলে হয়ে গিয়েছিল এরপর রঙ্গনাথ হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায়। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন সেলফোনের এত রমরমা বাজার শুরু হয়নি তবে নেট চালু হয়েছিল।
ই-মেলেই তাদের বার্তালাপ হত। রঙ্গনাথের একটা গান তখন সারা ভারত জুড়ে হিট। কিন্তু শেষ ই-মেইলটাতে দিব্য জানতে পারে রঙ্গনাথের পেছনে শত্রু লেগেছে, দিব্য তাকে কলকাতায় চলে আসতে বলে । আবার তারা একসঙ্গে কাজ করবে। কিন্তু এরপর আর কোনো ই-মেল আর আসেনি,আর রঙ্গনাথ, সেই সময় থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায়। আসলে সেই সময় থেকেই দিব্য আর অনিরুদ্ধর জীবনে এক নাটক শুরু হলো, তাই আর তারা রঙ্গনাথের কথা জানতে পারেনি।
ক্রমশঃ
অভিশপ্ত রাগিনী (দ্বিতীয় পর্ব)
রামানুজ দাশগুপ্ত :
শ্রী রামানুজ দাশগুপ্ত একজন বিশিষ্ট গায়ক,সুরকার ও বহুমুখী সঙ্গীত প্রতিভার অধিকারী। শাস্ত্রীয় সংগীত, ভজন, গজল, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, শ্যামা সংগীত থেকে আধুনিক গানের মাধ্যমে তাঁর প্রতিভা প্রকাশিত হয়। তিনি দীর্ঘদিন মুম্বাইতে প্রবাসী ছিলেন । দূরদর্শন কলকাতায় মিউজিক ডাইরেক্টরের পদ সামলেছেন। পরবর্তীকালে মুম্বাইয়ের ফিল্ম ডিভিশন অফ ইন্ডিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। এছাড়াও প্রখ্যাত মিউজিক ডাইরেক্টর আর ডি বর্মন, স্বপন চক্রবর্ত্তী ,শ্রীধর ফার্কে, রঘুনাথ শেঠ এর পরিচালনায় গান গেয়েছেন। রামানুজ মহাশয় এর সংগীত পরিচালনায় মহম্মদ রফি সাহেব, হৈমন্তী শুক্লা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অনুপ জালোটা, অনুরাধা পড়োয়াল, সুরেশ ওয়াডকর, রুনা লায়লা, কবিতা কৃষ্ণমূর্তির মতো স্বনামধন্য গায়ক–গায়িকারা গান গেয়েছেন। আমেরিকার নিউ জার্সির মেয়র শ্রী দাসগুপ্তকে ২০০০ সালে ” THE CITATION ” উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ২০১৫ সালে নজরুল একাডেমী তাঁকে ” নজরুল পুরস্কার ” প্রদান করে।