Shadow

রূপনগরের রূপকথা (প্রথম পর্ব ) – সিঞ্চন চট্টোপাধ্যায়

সিঞ্চন চট্টোপাধ্যায় রুপনগরের ছবি

রূপনগরের রূপকথা
সিঞ্চন চট্টোপাধ্যায়
(আমাকে ব্রাত্য করেছো জেনেও আজ তোমারি নামাবলী গায়ে আবার আমার মাধুকরী)
বাসবদত্তার মনের পাতা থেকে

বাবা মশাই বসে আছেন মঞ্চে, তার নিজের কথায় “রঙ্গমঞ্চ”।সামনে শতাধিক ভিন্ন বয়সের পুরুষ ও মহিলা বসে আছে। একের পর এক প্রশ্ন শুনছেন, টিপ টিপে হাসছেন, স্বভাবজাত ভঙ্গিতে উত্তর দিচ্ছেন। কেউ অবান্তর প্রশ্ন করলে ডান হাত তুলে থামিয়ে দিচ্ছেন।মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে ভেবে নিচ্ছেন। তারপর চোখ খুলে প্রশ্নকর্তার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিচ্ছেন। বেলা প্রায় বারোটা। ভোর পাঁচটা থেকে শুরু হয়েছে রঙ্গমঞ্চ। এবেলায় আরো একঘন্টা চলবে। আজ বাবামশাইয়ের শরীরে বাসন্তী রং। খোলতাই ফর্সা রঙে বাসন্তী রং মানায় খুব ভালো। এই পোশাক বাসবদত্তা নিজে হাতে সেলাই করেছে, তাই এটা বাবামশাই পরলে ওর মনটা ভালো থাকে। শুরুতে ভালই ছিল, যত সময় এগোচ্ছে ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। যদিও রূপনগরে খারাপ মেজাজ প্রকাশ করার সাহস বা অধিকার কারো নেই। তবুও মনটাকে তো আটকানো যায় না। হৃদপিন্ডের, ফুসফুসের, মস্তিষ্কের চলমান স্নায়বিক ক্রিয়ার মত মনটাও কাজ করে চলে ।
বাসবদত্তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে বাবামশাই এর জন্য। আজ ওর দাঁড়াবার জায়গা যেখানে, সেখান থেকে মঞ্চ অনেকটাই দূরে। দু-দুবার ইশারা করে ফলের রস পাঠিয়েছে বাসবদত্তা, কিন্তু দুবারই বাবামশাই হাত নেড়ে তা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। আজ আবার বাবামশাই এর উপবাসের দিন। বছর দশেক আগে যখন রূপনগর তৈরি হচ্ছে সে সময় তিনি সারাদিন জলগ্রহণও করতেন না। ইদানিং অনেক বোঝানোর অনেক আবদারের পর কিছুটা মেনেছেন দিনের বেলায় ফলের রস, সূর্য ডুবলে দু-একটা ফল, ওটুকুই। আজ তো ফলের রস মুখেও তুললেন না। কেশমুক্ত মাথা মুখে এই গরম কালে ঘাম জমে ওঠে, কষ্ট পান,তাই ঠান্ডা জলে ভেজানো তোয়ালে মাঝে মাঝে তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি তোয়ালে দিয়ে ঘাড় মাথা হাত মুখ মুছে নেন। আজ হাতের তোয়ালে হাটুতে রাখাব্যবহার করার সময় পাননি। এতক্ষণে গরম হয়ে গেছে। বাসবদত্তার আজ কিছু করার নেই তাই তার রাগ হচ্ছে বেশি। আজ মঞ্চে যেসব সেবক রয়েছে তারা কিছু করছে না কেন! পাশাপাশি রয়েছে লালন, অস্টিন, রয়েছে আল্লারাখা আর সেবিকা অহল্যাবাই, ওরা কেন একটুও খেয়াল রাখে না বাবামশায়ের !
-সেই কোন ভোরবেলা থেকে শুধু কথা বলেই চলেছেন। বাবামশাইয়ের উত্তর শুনে একটু হেসেই ফেলল বাসবদত্তা।
সামনে বসা ঘুংঘট ঢাকা মহিলা প্রশ্ন করেছিল,
-কি করব ঘরের মানুষ আমার সঙ্গে ঘর করে না, অন্য মেয়ে মানুষের কাছে যায়। বলুননা বাবামশা‌ই, কি করে ঘরে বেঁধে রাখতে পারি আমার ঘরের মানুষকে।
উত্তরে বাবা মশাইয়ের সেই টিপ টিপে হাসি তারপর খোলতাই উত্তর
-“দেখো দেখি এ মেয়ে তো আমার কাছে বশীকরণ শিখতে এসেছে গো ! ও বিধি আমার জানা নেই মা। বলি, রান্না জানো? ঘরের মানুষকে ভালো রেঁধে খাওয়ালে, ওই রান্নার টানেই সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফেরে গো। ও মেয়ে তোমার তো সবকিছুই আছে, তবে তোমার ঘর না করে, ও পুরুষ অন্য ঘরে যায় কেন ? নিজেকে একবার প্রশ্ন করে দেখো!এখানে তোমার কিচ্ছুটি হবার নেই গো। তুমি বরং অন্য কোথাও বশীকরণ শেখো। আর শোনো মেয়ে, যদি শিখতে পারো আমায় কিন্তু শিখিয়ে যেও।“
এবারে প্রশ্ন করতে এগিয়ে গেল পৃথুলা মধ্যবয়সী মহিলা । সঙ্গে সুপুরুষ যুবক হাত ধরে যেভাবে এগোচ্ছিল শরীরের ভারসাম্য সামলে তাতে অনায়াসে বোঝা যায় মহিলার হাঁটুতে সমস্যা রয়েছে। কিন্তু যেভাবে যুবক সামলাচ্ছে তাতে বোঝা যায় যুবক মহিলার সন্তান বা সন্তানতুল্য। প্রত্যেক প্রশ্নকর্তার জন্য জায়গা ঠিক করা আছে সেখানে গিয়ে বসতে হয় এবং প্রশ্ন করতে হয় যাতে বাবামশাই প্রশ্নকর্তাকে ঠিকভাবে দেখতে পান প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলে প্রস্থানের দিকনির্দেশ দেওয়া আছে ওই পথেই এগিয়ে যেতে হয়।
রঙ্গমঞ্চের এলাকা থেকে বেরিয়ে যার ইচ্ছে রূপনগর ছেড়ে যেতে পারে, ইচ্ছে হলে থাকতেও পারে।
পৃথুলা মহিলা গিয়ে বসলেন। সঙ্গী যুবককে বাবামশাই ইশারা করতে সেও বসলো। মহিলা শুরু করলেন,
-বাবামশাই আপনাকে আমার এই ছেলে ইমেইলে সবকিছু লিখেছিল। আপনি দেখতে চেয়ে ছিলেন বলেই আমরা এলাম। আপনি তো জানেন আমরা প্রবাসী। এলাহাবাদে থাকি। বাবামশাই হাত তুললেন। অর্থাৎ থামো, থেমে যাও।
হাত নামল, চোখ খুললো, স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন
 – তোমার নাম তো তন্ময় ! আর তোমার  মায়ের নামটা কি যেন ! ছেলে উঠে দাঁড়ালো। বাবামশাই বসার ইঙ্গিত করতে আবার বসে পড়ল।
– মায়ের নাম প্রীতিলতা।
– বা: মায়ের তো বেশ নাম, তবে মা যা বললেন, আমি তোমাকে দেখতে চেয়েছ্‌ সে কথাটা ঠিক নয। আমি লিখেছিলা্‌ম, তোমার দর্শন আকাঙ্ক্ষী। দেখা আর দর্শনের মধ্যে অনেক তফাৎ। আচ্ছা তন্ময় বল দেখি, রূপনগরে প্রবেশ থেকে এখানে আসা পর্যন্ত তুমি তো অনেক কিছুই দেখেছো!চলার সময়  পথের দিকেও তাকিয়েছো!এবার বল দেখি, কত পা তোমাকে চলতে হয়েছে এখানে পৌঁছবার জন্য।
প্রশ্নকর্তার চোখেমুখে রহস্যের হাসি।উত্তরদাতা বিব্রত, এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে নজর নিচের দিকে।
– আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে, অত লজ্জা পেতে হবে না। নতুন জায়গা অত কি দর্শন হয়। আমার জুতো আট নম্বর এবং আমি যেভাবে হাটি তাতে পঁচাত্তর টা পদক্ষেপ করতে হয় কখনো ছিয়াত্তর।
আচ্ছা বাবা ,ট্রেন থেকে নেমে তুমি কিসে এলে রূপনগরে! গাড়িতে করে তাইতো ? আচ্ছা বলতো তোমার গাড়ির চাকাটা কতবার ঘুরে ছিল ?
উত্তরদাতার মুখটা আরো নিচের দিকে ঝুকলো বলে মনে হল। তুমি আমাকে হতাশ করলে তন্ময়। এটাতো দর্শন নয়, এটাতো বিজ্ঞান।
ব্যক্তিগত গাড়ির চাকা একবার ঘুরলে 0.৯৪২ মিটার জায়গা লাগে। এক কিলোমিটার মানে ১০০০ মিটার । তাহলে কি দাঁড়ালো একটা চাকা এক কিলোমিটার চললে ১০৬১.৬ বার ঘোরে। আমি ইমেইলে জানিয়েছিলাম স্টেশন থেকে রূপনগর সাড়ে বার কিলোমিটার। অর্থাৎ চাকাটা 13 হাজার 270 বার ঘুরেছে l
ন্ময়, এবার আসল প্রসঙ্গে আসা যাক কেমন ! তুমি দর্শনশাস্ত্রে পিএইচডি করেছ। প্রফেসরের চাকরি ছেড়ে রূপনগরে এসে থাকতে চাও কেন,‌ তাও জানিয়েছ ইমেইলে। আমার কথা, আমাদের কথা, জানতে পেরেছো আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ডক্টর আলেক্স এর কাছে। এখানকার সব নিয়মকানুন জেনেই তুমি এখানে থাকতে চেয়েছ। কিন্তু তুমি তোমার মায়ের একমাত্র সন্তান, তাই তোমার মায়ের কাছে আমার প্রশ্ন, উনি কি করে তোমাকে ছেড়ে থাকবেন?
বাবামশাই এবার ছেলের মায়ের দিকে তাকালেন। প্রীতিলতা অবাক হয়ে বাবামশাই এর কথা শুনছিলেন । বাবামশাই এবার চিরাচরিত স্নেহ ঢালা কন্ঠে বললেন, বলো মা, তুমি কি করে ছেলেকে ছেড়ে থাকবে ?
ধাতস্থ হয়ে প্রীতিলতা বললেন
– ওর বাবা মিলিটারির অফিসার ছিলেন। চিরকাল দূরে দূরেই কাটিয়ে শেষের দিকে কার্গিল থেকে আর ফিরে এলেন না।
চেয়েছিলেন ছেলেও সেনাবাহিনীতে যাক। কিন্তু তা তো হল না। তাই ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। আমারতো টাকা-পয়সার কোন অভাব নেই সরকারি পেনশনও আছে। তাই আমার ইচ্ছা, তন্ময়ের এতকালের রোজগারের জমানো টাকা যা আছে তা সব ও রূপনগরের কাজে দিতে চায় আর আমার তাতে কোন আপত্তি নেই । শুধু আপনার অনুমতি পেলে আমি মাঝে মাঝে এসে আপনাকে আর তন্ময় কে দেখে যেতে পারি কি ?
-মাগো, এখানে শুধু আমি থাকিনা, আমরা সবাই থাকি। এখানে অনেক তন্ময়, অনেক মৃন্ময়, অনেক জন্মেজয় আছে।সবাইকে যদি দেখতে ইচ্ছে হয় তবে এসো। যখন ইচ্ছে তখন এসো। ছেলেকে দেখতে ইচ্ছে হলে জানিও, ওকে আমি তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো।
ছেলেবেলায় যখন পড়তাম “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী”। বাংলাটা বুঝলেও, মানেটা বুঝতে পারতাম না l তোমাদের দেখলে আজ কথাগুলোর মানেটা বুঝতে পারি। হাত দুটো জোর করে বুকের কাছে নামিয়ে নিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলেন বাবামশাই। হয়তো কিছু প্রার্থনা করলেন পরমেশ্বরের কাছে অথবা কোন সংকল্প করলেন নিজের কাছে। কেউ কিছু বুঝলো না সবাই ওনার দেখাদেখি হাতজোড় করলো চোখ বন্ধ করে মাথা নীচু করল। বাসবদত্তা বাবামশাইয়ের  এই সময়ের সাক্ষী বহুবার হয়েছে। তাই ওর চোখ অশ্রুমুখী হল।

                                                   (রূপনগরের রূপকথা চলবে আগামীপর্বেও)

সিঞ্চন চট্টোপাধ্যায় ছবি

সিঞ্চন চট্টোপাধ্যায় :
লেখক খুব অল্প বয়সেই লেখা শুরু করেন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই গল্প ,কবিতা, উপন্যাস এবং নাটক লিখতে শুরু করেন ছাত্রাবস্থা শেষ করার পর প্রথম হাতে খড়ি তৎকালীন ভারত কথা পত্রিকার সাংবাদিকতা  সঙ্গে চলতে থাকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ফ্রিল্যান্সিং এরপর জীবিকার জ্যামিতিক আকারের মধ্যে ঘোরাফেরা দেশবিদেশ দেখা এবং সময় সময় লিখতে থাকা আজ কুলায় ফেরার পাতায় অনুভবের ছবি লেখা শুরু নতুন আঙ্গিকে এবার ধারাবাহিক উপন্যাস যে স্বপ্ন প্রত্যেক মানুষ কখনো না কখনো দেখেন বা দেখেছেন, এক  সুস্থির সুন্দর সুমার্জিত সমাজ জীবন ! তারি লেখা চিত্র ফুটিয়ে তুলতে চলেছেন লেখক সিঞ্চন চট্টোপাধ্যায়

2 Comments

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!