দীর্ঘ ও হ্রস্ব
অগ্নিমিত্র ভট্টাচার্য্য
প্রথম যুগের শান্তিনিকেতনের ছবি যখন মানসপটে ফুটে ওঠে, রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে যে সকল দিকপাল মানুষের উপস্থিতি সেই সময়ের আশ্রমকে সৌরজগতের মতো অধিষ্ঠিত করে তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অন্যতম! সম্পর্কে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নাতি। রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ২০ বছরের বড়ো ছিলেন কবির চেয়ে, তাঁর নাতি দীনেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে ঠিক ২০ বছরের ছোট। তাঁর মতো সদাহাস্যময়, সুকন্ঠের অধিকারি, নাট্যকুশলী, স্নেহময়, অতিথিবৎসল ও সর্বোপরি বিশাল মাপের সঙ্গীত প্রতিভা শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে বিরল! রবীন্দ্রনাথের রচিত প্রায় আড়াই হাজার গানের সিংহভাগের স্বরলিপিকার, শান্তিনিকেতনের অন্যতম প্রাণপুরুষ দীনেন্দ্রনাথকে, রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র তাঁর “গানের ভাণ্ডারী” আখ্যায় ভূষিত করেই ক্ষান্ত থাকেন নি, তাঁর পরম স্নেহের “দীনুর” নামেরও পরিবর্তন সাধন করে নিজের নামের সাথে চিরকালের বন্ধনে আবদ্ধ করে যে পরম স্বীকৃতি তিনি দিয়েছিলেন, সেই কাহিনীই শোনাবো এখন!
ঠাকুর বংশের নিয়মানুসারে, বংশের প্রথম সন্তানের নামের আদ্যক্ষর তাঁর পিতার আদ্যক্ষরটি দিয়েই
হোত তাই প্রিন্স দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম দ্বিপেন্দ্রনাথ ও তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের নামকরণ করা হয়েছিল দীনেন্দ্রনাথ। দীনেন্দ্রনাথ নিঃসন্তান ছিলেন এবং দুর্ভাগ্যবশত সেই কারনে এই বংশতালিকা ঘটিত নামকরনের প্রক্রিয়ার এখানেই সমাপ্তি ঘটে। এই একই কারণে, রবীন্দ্রনাথের পর রথীন্দ্রনাথ নিঃসন্তান ছিলেন বলে ” র” আদ্যক্ষরের পরিসমাপ্তি ঘটে রবীন্দ্রনাথের বংশলতিকায়।
এবারে ফিরে আসি দীনু ঠাকুরের নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের ভাণ্ডারীকে তাঁর নামের সাথে সমার্থক শব্দবন্ধ দিয়ে একাঙ্গী করে রাখতে চেয়েছিলেন, যাতে তিনি আর দীনু যেন একই বৃন্তে দুটি কুসুমের মতো চিরকাল মানুষের মনে অভিন্ন ভাবে বিরাজমান থাকেন। কিন্তু বংশের নিয়মানুসারে সরাসরি নাম পরিবর্তনে তিনি ছিলেন অপারগ! কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্বয়ং সরস্বতীর বরপুত্র! শব্দকে অভীষ্ট রূপ প্রদান করার ক্ষমতা ছিল তাঁর কাছে কর্ণের কবচ কুন্ডলের মতো সহজাত এবং সহজসাধ্য! তিনি দীনেন্দ্র (সন্ধি বিচ্ছেদ কালে দীন+ ইন্দ্র অর্থে দীন দরিদ্রের ইন্দ্র= নারায়ণ ) নামের বানান পরিবর্তন করে দিলেন দিনেন্দ্র (দিন+ ইন্দ্র অর্থাৎ দিনের ইন্দ্র যার অপর অর্থ সূর্য বা রবি) এবং সর্বক্ষেত্রেই দিনেন্দ্র নামের ব্যবহার শুরু হল, দীনেন্দ্র নামের পরিবর্তে। দীনু ঠাকুর হয়ে উঠলেন দিনু ঠাকুর , আশ্রমের সকলের আদরের ” দিন দা” আর ছাপার অক্ষরে গীতিকার ও সুরকার রবীন্দ্রনাথের নামের সাথে স্বরলিপিকারের নাম লেখা শুরু হলো দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিসাবে । লক্ষ্যনীয় এই যে আজীবন দিনু ঠাকুর তাঁর পরিবর্তিত নামই সর্বত্র ব্যবহার করে এসেছিলেন তাঁর পূজনীয় ” রবিদাদার” একনিষ্ঠ ভক্ত, সেবক ও গান – ধারী হিসাবে। শেষ জীবনে এই প্রাণবন্ত পুরুষ অনেক ব্যথা ও যন্ত্রণা নিয়ে শান্তিনিকেতন পরিত্যাগ করে জোড়াসাঁকোর বাসভবনে চলে আসেন এবং অতি অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়! কিন্তু সে আর এক অন্য ঘটনা!
তথ্যসুত্রঃ দিনেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কের খতিয়ান – শোভন সোম
*******************************************
অগ্নিমিত্র ভট্টাচার্য্য:
জন্ম, স্কুল, কলেজ সবই কলকাতা। কর্মজীবন কেটেছে অবশ্য বিশাখাপত্তনম, অন্ধ্র প্রদেশে। সঙ্গীত প্রিয় ও রবীন্দ্রানুরাগী!
অপূর্ব সুন্দর কুলায় ফেরা র প্রথম নিবেদন। সব রচনা ও কবিতায় প্রাণ আছে, মান নেই। সরল কিন্তু গভীর। মনন আছে, আছে নিজেকে উজার করে গুটিয়ে থাকা। এ এক আনন্দ উৎসব, আছে নিবেদন, শান্তি ও শুদ্ধ প্রকাশ। প্রতীকে নিজেদের আপন অর্ঘ্য সাজিয়ে সুন্দর মালা গেঁথে কুলায় ফিরেছেন।
সাধুবাদ দিয়ে ছোট না করে বলি, ” যা শিখেছি, যা পেয়ে ছি, তুলনা তার নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিলাম শুধু তাই ‘। সবাই ভালোবাসা ও প্রণাম নেবেন.
অপূর্ব, মন কেড়ে নেওয়া প্রবন্ধ। কবিগুরুর ” গানের ভান্ডারী “– দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, দিনেন্দ্রনাথ তথা দিনু ঠাকুর হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনী পড়ে মুগ্ধ হ’লাম ! … পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর শান্তি নিকেতন ছেড়ে জোড়াসাঁকোয় ফেরার কাহিনী জানার জন্য উৎসুক অপেক্ষায় রইলাম !!
অসাধারন তথ্য। আলোকিত হলাম। অনেক ধন্যবাদ