
গুরুদেবের জয় হোক
ব্রতী ঘোষ
সকাল ছ‘টার অ্যালার্ম টা বেশ কিছুক্ষণ ধরে বেজে চলেছে। সোমনাথ জেগে শুয়ে আছে বিছানায় । আজ আর ভালো লাগছে না উঠতে। রোজকারের একঘেয়েমিতে মনটা একেবারে বিরক্তিতে ভরে আছে । আজ থেকে ও কিছুতেই মৃদুলার কথায় চলবে না । ওর মন যা বলবে সেই ভাবেই চলবে। ও ঠিক করেছে এখন বিছানা ছেড়ে কিছুতেই উঠবে না কিন্তু এইরকম বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা শুধু তো করলেই হয় না তাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে গেলে যথেষ্ট দম থাকা দরকার। সোমনাথও সেই দমকে ধরে রেখে বিছানায় পড়ে আছে| দেখা যাক্ ! কতক্ষণ ধরে রাখতে পারে ! যেইমাত্র ভাবনাটা মাথায় এলো অমনি কোথা থেকে যেন একটা ঝড়ের মতো হাওয়া এসে ওকে বিছানা থেকে ফেলে দিল | কোথা থেকে ঝড় এলো,কখন এলো,কিছু তো আগাম বোঝা গেল না | এইসব ভাবতে ভাবতেই ও দেখলো ওর সামনে মা ছিন্নমস্তার ভঙ্গিতে মৃদুলা দাঁড়িয়ে আছে | শুধু ওর মুন্ডুটা ছেঁড়াটারই যা অপেক্ষা | আর যেটা সম্পন্ন হলেই মা ছিন্নমস্তার পরিপূর্ণরূপ প্রকাশিত হবে | সোমনাথ আর কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল | সকালবেলা চেঁচামেচি শোনার ইচ্ছে ওর নেই |
” টাপুর টুপুর কে স্কুলে কি আমি নিয়ে যাব ? ঢং করে শুয়ে রয়েছে যে বড় ? আমার বুঝি আর শুতে ইচ্ছা করে না ? সেই ভোর পাঁচটায় উঠে মেয়েদের টিফিন,তোমার টিফিন গুষ্টির জন্য রান্না সবই তো শুরু হয়ে গেছে। কতদিন হয়ে গেছে ভোরবেলা একটু হাঁটতে যেতে পারিনি | যাব যে তার উপায় কি আছে ?”
” উফ্! আবার রেডিওটা চলতে শুরু করলো | আচ্ছা প্রতিদিন একই কথা পরপর কি করে বলো বলতো ? “- বাথরুমের দরজাটা টুক্ করে খুলে কথাগুলো বলেই সোমনাথ দরজাটা বন্ধ করে দেয় | ভাগ্যিস বন্ধ করেছিল | বাথরুমের দরজায় ধড়াম্ করে একটা শব্দ হলো | বোধহয় হাওয়াই চটিটা উড়ে এলো | দরজা খুলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোমনাথ দেখে যা ভেবেছিল তাই–হাওয়াই চটি টা দরজার সামনে পড়ে আছে ।
টাপুর আর টুপুর কে নিয়ে সবে বাইকটা স্টার্ট দিয়েছে এমন সময় আবার চিৎকার,”ওদের টিফিন টা কি আমি নিয়ে যাব?” সোমনাথ কোন কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘর থেকে দুটো টিফিন বক্স নিয়ে এসে দুই মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিল।
আচ্ছা ! এই দুর্দিন থেকে মুক্তির কি কোন উপায় নেই ? বছর আটেক আগেও কত শান্তি ছিল ওর জীবনে | কত সাধ করে নবেন্দুকে নিয়ে ও মৃদুলা কে দেখতে গিয়েছিল | সেদিন গোধূলির স্নিগ্ধ আলোতে মৃদুলা কে দেখে ওর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলে মনে হয়েছিল । কি অপূর্ব ছিল সেই চোখের চাহনি ! এক্কেবারে ‘ উৎসবে ‘ র ঋতুপর্ণা যেন | আর সেই চকিত চাহনিতে হারিয়ে যেতে যেতে নিজেকেও মনে হয়েছিল প্রসেনজিৎ | কিন্তু বিয়ের ঠিক তিন মাস পর থেকেই ওর এত সাধের স্বপ্ন একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করেছিল আর আজ ওর সেই ড্রিম গার্ল ঋতুপর্ণা কিনা ওকে হাওয়াই চটি ছুঁড়ে মারল | ভাগ্যিস ও বাথরুমে ঢুকে গেছিল | বুকের ভেতর থেকে একটা ব্যথা ডুকরে উঠে গলা দিয়ে বের হতে গিয়েও বেরোলো না | তার বদলে একটা কিঁউ কিঁউ শব্দ বেরিয়ে এলো | টাপুর অনেকক্ষণ ধরে বাবাকে খেয়াল করছিল | বলল,” বাবা ! এমন কুকুরের মত আওয়াজ বের হচ্ছে কেন তোমার গলা দিয়ে ? ”
সোমনাথের এই একটাই সান্ত্বনা | টাপুর ওকে একমাত্র ঠিকঠাক বোঝে। ওর মনের ব্যথা,যন্ত্রণা সব | কোনরকমে চোখের জল সামলে সোমনাথ বলে,”নারে মা ! একটু হেঁচকি উঠলো |”
টাপুর টুপুর কে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে সোমনাথ আজ ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের সামনে রাধুদার চায়ের দোকানে এসে বসে । রাধুদার হাত থেকে চা টা নিতে নিতে চোখ যায় সুখলতা বৌদির দিকে | কি সুন্দর শ্রীময়ী বউ রাধুদার ! আহা এমন বউ কেন সবার হয় না ? কি সুন্দর হাতে হাতে রাধুদাকে সাহায্য করছে | আবার ঠিক সময় বুঝে ছেলেটাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসছে। আবার বাড়ির রান্না করে রেখে রাধুদা কে বিকেল থেকে সাহায্য করছে। এতটুকু বিরক্তি নেই | নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সোমনাথের | বাড়ি ফিরে আবার ঝড়ের মুখে পড়তে হবে | কোনরকমে মুখে চারটি গুঁজে অফিসের পথে হাঁটা দিল ও । সারাদিনের কর্মশ্রান্তির পর বাড়ি ফিরে আবার মেয়েদের নিয়ে পড়াতে বসালো । সৈকতকে দেখো । বাড়ি ফিরে চা নিয়ে সিরিয়াল দেখে বউয়ের সঙ্গে। তারপর নটা থেকে দশটা পাড়ার ক্লাবে আড্ডা মেরে বাড়ি ঢুকে ও | সকালেও কোন তাড়া নেই | আসলে ওর তো ছেলেপুলে নেই | তাই আরো আনন্দে আছে | সত্যি ,হিংসায় সোমনাথের বুকটা জ্বলে পুড়ে যায় | একেই বলে কপাল। স্বামী–স্ত্রীতে মিলে প্রত্যেক মাসে আজ এখানে কাল সেখানে বেড়াতে চলে যাচ্ছে । কোনো চিন্তা নেই । ভগবান ! তুমি একটু মুখ তুলে চাও ।
সোমনাথ ও তো ভেবেছিল সারা জীবন “তোমায় আমায় মিলে” কাটিয়ে দেবে স্বপ্ন মধুর মোহে |
মৃদুলা কে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল ও,’দেখো তুমি আর আমি মিলে চমৎকার কাটিয়ে দেবো এই জীবনটা।‘ কিন্তু সে কথা ছিন্নমস্তা শুনলে তো ? কি অশান্তি যে শুরু করেছিল !
‘ চার বছর হয়ে গেছে | আমার মেয়ে চাই ! সময় কাটে না | প্লিজ ! কিছু একটা করো ! ‘
সেই সময় থেকেই জীবনটা আরও যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল | প্রত্যেক মাসে একই কাঁদুনি ! এই মাসেও কিছু করতে পারলে না। আরে বাবা ! সব যদি আমার ইচ্ছাতেই হত তাহলে তো হয়েই যেত। এরপর যখন সুসংবাদটা এলো তখন সেই আনন্দ ও যেন হরিষে বিষাদ | জানা গেল যমজ সন্তান আসছে ওদের । সেই দোষও সোমনাথের | সোমনাথ নাকি ইচ্ছে করে মৃদুলা কে যমজ সন্তানের মা করে ফাঁসিয়েছে । যাক্ ! সেইসব দুঃখের কথা আর নাই বা বলল সোমনাথ । টাপুর টুপুর এসে ওর জীবনটা আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে । টাপুরের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিন্নমস্তার কথার জ্বালা যেন জুড়িয়ে যায়| বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে টাপুর যেন নিজের মায়ের মত সব বুঝতে পারে । মেয়েটা বড় পয়া হয়েছে । জন্মানোর পরেই ওর প্রমোশনের খবরটা এলো | অবশ্য মনে হতে পারে টুপুর ও তোএকই সঙ্গে জন্মেছে । তাহলে টাপুর পয়া হল কি করে ?
আসলে হলো কি ! টাপুর জন্মানোর এক ঘন্টার পর টুপুর জন্মালো । আর এই এক ঘন্টার মধ্যেই প্রমোশনের খবরটা সোমনাথ পেল | টুপুরটা হয়েছে এক্কেবারে সোমনাথের শাশুড়ি মায়ের মত | কি করে যে একই মেশিন থেকে এরকম দুটি বিপরীত মেরুর মানুষের ফটোকপি বেরোয় সেটা সত্যিই পৃথিবীর নবম আশ্চর্য |
এরপর শাশুড়ি মা এসে ওদের সংসারের হাল ধরলেন | সোমনাথের মা ও বাধ্য হলেন মেয়ের বাড়ি চলে যেতে | আর সেই থেকে ওর যাবজ্জীবন কারাবাসের শুরু | উঠতে বসতে শাশুড়ি মায়ের আদেশ আর উপদেশে সারা বছর ধরেই টাক্ ডুম টাক্ ডুম বাজতে লাগলো | তবে ভগবান যে একেবারেই অবুঝ বা ওর প্রার্থনা কানে তোলেননি তা বলা যাবে না| এই একবছর হলো শাশুড়ি মা চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে । সে যে কত দিনের প্রার্থনার ফল সেকথা একমাত্র মা কালিই জানেন আর ও জানে | তবে দোষের মধ্যে একটাই খালি ভুল হয়ে গেল যে হসপিটাল থেকে ওর মৃত্যু সংবাদটা আসামাত্রই সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিতে সোমনাথ ছুটেছিল । সঙ্গে ছিল টুপুর | পুজো দিতে গিয়ে ওর মানত পূর্ণের কথা আনন্দের চোটে একটু জোরে জোরেই বলে ফেলেছিল | ব্যাস্! শাশুড়ি মা যে সেদিন থেকে টুপুরের ওপর ভর করবে সে কি আর ও জানতো ? বাড়ি এসে মাকে গড়গড় করে সব বলে দিল | এরপরে তিনমাস সোমনাথের অবস্থা যে কি হয়েছিল নিজের মুখে আর নাই বা বলল ! অনেক কষ্টে ভুজুং ভাজুং দিয়ে মাস তিনেক পরে মা ছিন্নমস্তা ঘাড় থেকে নামেন । অবশ্য এখনো মাঝে মাঝে সেই নিয়ে কথা শুনতে হয় ওকে । তবে আজকে সকালের হাওয়াই চটি ছুঁড়ে মারার ঘটনাটা ওকে ভারী কষ্ট দিচ্ছে | ইচ্ছা করছিল ওই হাওয়ায় চটি তুলে তখনই খান কত লাগিয়ে দেয় ছিন্নমস্তার গালে। কিন্তু সেই সাহস তো আর ওর নেই।
অফিসে সারাটা দিন গুমড়ে বসে রইলো সোমনাথ। ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট অফিসের পাশের কিউবিকলে বসেন কল্যাণীদি । উনি সোমনাথের থেকে বেশ খানিকটা বড় । ওকে বেশ স্নেহ করেন । সকাল থেকে সোমনাথকে খেয়াল করছিলেন | বিকেলের দিকে ওকে চেপে ধরলেন | ছলছল চোখে সোমনাথ ওর দুঃখের কথা খুলে বলল | সব শুনে উনি বললেন,’আমার সঙ্গে চলো একটা জায়গায়,সব ঠিক হয়ে যাবে।‘
আজ সোমনাথের বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি ই হল | তবে সকালে যে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বেরিয়েছিল সেই তুলনায় এখন মনটা বেশ হালকা| কল্যাণীদির গুরুজি ওকে একটি টোটকা ওষুধ দিয়ে বলেছেন,রোজ সকালে ছিন্নমস্তার থুড়ি মৃদুলার চায়ের সঙ্গে এক চামচ করে এই পাউডার গুলো মিশিয়ে দিতে,পরপর ৩০ দিন| মাসের শেষে কড়কড়ে দশ হাজার টাকা দিতে বেশ গায়েই লাগছিল | কিন্তু এই মহৎ উদ্দেশ্যে ১০ হাজার কেন ১০ লাখ ও ব্যয় করতে ও প্রস্তুত । গুরুদেব যে মৃদুলার চরিত্র একেবারে হুবহু বলে দেবেন সে কথা সোমনাথ ভাবতেও পারেনি। যাক্ বাবা ! আগামীকাল থেকে কাজ শুরু করতে হবে ।
পরদিন বেশ সকালেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল সোমনাথ। মৃদুলা সকালে বাথরুম থেকে বেরিয়েই দেখল ওর জন্য চা রেডি| এতো এ বছরের সেরা বিস্ময়| যে লোক ডাকতে ডাকতে ঘুম থেকে ওঠে না সে কিনা না ডাকতেই ঘুম থেকে উঠে একেবারে চা তৈরি করে রেখেছে ওর জন্য| ভাবলো একবার কিছু বলবে| কিন্তু গতকাল একটু বেশিই রেগে গেছিল মৃদুলা । যদিও হাওয়াই চটিটা সোমনাথের গায়ে লাগেনি কিন্তু লাগতে তো পারতো | সেই জন্য মনে মনে একটু লজ্জিতই ছিল ও আর তারপর থেকে সোমনাথ ও একটা ও কথা বলেনি । তাই আজকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না মৃদুলা | কি করবে ও ? ওর যে মাথাটা উল্টোপাল্টা কাজ দেখলে দুম করে গরম হয়ে যায় ! আজ চা টা একেবারে রেডিমেড পেয়ে যাওয়াতে ওর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো | সোমনাথ ও সুযোগ বুঝে গুরুদেবের পাউডারটা মৃদুলার চায়ে মিশিয়ে দিল । চায়ের কাপটা মৃদুলার সামনে রেখে নিজের কাপটা নিয়ে শোবার ঘরে চলে এলো । তবে ঘর থেকে নজর রাখতে লাগলো যে চা টা মৃদুলা খাচ্ছে কিনা ! চা টা ওকে খেতে দেখে বেশ নিশ্চিন্ত হলো | তবে চা–টা খাবার পর এত তাড়াতাড়ি যে ওষুধটা কাজ করতে শুরু করবে সেটা ও ভাবতেই পারেনি | সকাল থেকে বাড়িতে কোন চেঁচামেচি নেই | একেবারে দখিনা বাতাস বইছে ফুরফুর করে| সোমনাথ নিজের অজান্তেই একটা গান গেয়ে উঠলো,’ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।‘
না: সব ক্রেডিট কল্যাণীদির| কল্যাণী দিকে একটা ভালো শাড়ি কিনে দিতে হবে | লাঞ্চ টাইমে টিফিন বক্স খুলেই সোমনাথ ওর সাধের লুচি আলুর দম দেখে ও আরো নিশ্চিন্ত হল যে ওর দুঃখের দিনের অবসান আসন্ন | কল্যাণীদিকেও সুখবরটা দিলো | কল্যাণীদি বললেন,’তুমি আগে আমাকে বলনি কেন ? তাহলে কবেই সব ঠিক হয়ে যেত।‘
দ্বিতীয় দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো | মৃদুলা আজও রেডিমেড চা পেয়ে বেশ খুশি | প্রতিদিন সকালে ঠেলে ঠুলে সোমনাথকে তুলতে হচ্ছে না | আসলে ভোর থেকে ও যখন মেয়েদের টিফিন,সোমনাথের অফিসের টিফিন,রান্না এইসব নিয়ে নাজেহাল হয়ে যায় তখন সোমনাথের নাক ডেকে ভোস্ ভোস্ করে ঘুমানো দেখলেই ওর মাথাটা গরম হতে শুরু করে । তারপর ঠেলতে ঠেলতে যখন ওঠে না তখন ও আরও মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে চিৎকার দিতে শুরু করে । মেয়েদের স্কুল থেকে নিয়ে আসা,সারাদিনের হুজ্জোতি সামলানো,এরপর টিউশনে নিয়ে যাওয়া সবই তো একা হাতে করতে হয় মৃদুলাকে। সে কথা সোমনাথ একবার ও ভাবে ? মনের দুঃখের কথা কাকে বলবে ও ? সোমনাথ ভাবতে পারেনি আজ টিফিন বক্স খুলে ওর প্রিয় চিঁড়ের পোলাও দেখতে পাবে | সোমনাথের আর কোন সন্দেহ রইল না যে ও সব দুঃখের অবসান হয়েছে। এইভাবে যে ওষুধটা কাজ করবে ও ভাবতেই পারেনি। আজ অফিস ফেরত দাবুদার দোকান থেকে চারটে ফিস ফ্রাই কিনে ফিরলো। বাড়ি ফিরতেই টাপুর টুপুর ফিস ফ্রাই দেখে বেজায় খুশি আর খুশির রঙের আভা যেন একটু হলেও খেলা করছে মৃদুলার গালে।আচ্ছা মৃদুলার মুখের বাঁ দিকটা আজ একদম ঋতুপর্ণার মত দেখতে লাগছে না ! যদিও দুদিন ধরে স্বামী–স্ত্রীতে কথা হয়নি সরাসরি | মৃদুলা টুপুরকে দিয়ে আর সোমনাথ টাপুরকে দিয়েই সংসার চালানোর কাজটা চালিয়ে নিচ্ছে ।
তৃতীয় দিন ও যথারীতি সকাল–সকালে উঠে সোমনাথ চা বানিয়ে পাউডার মেশানোর কাজটা সেরে ফেলল | এইভাবে দিনগুলো বেশ সোনালী রঙে মুড়ে প্রতিদিনই ধরা দিতে লাগলো | মৃদুলার ও মনটা বেশ ফুরফুরে থাকে | সকালবেলাটা যদি কারো সুন্দর করে শুরু হয় তবে সারাটা দিন তো ভালো কাটবেই | ওর এখন আর আগেকার মত মাথা গরম হয় না ।
একদিন হলো কি ! সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সোমনাথ যথারীতি রান্নাঘরে ঢুকেছে চা তৈরি করতে | টুপুরও বাবার পিছন পিছন কখন যে এসেছে সেটা সোমনাথ খেয়ালই করেনি । হঠাৎই,”মা দেখো দেখো ! বাবা তোমার চায়ে পাউডার মেশাচ্ছে | “চিৎকার শুনে সোমনাথের প্রায় ভিরমি খাওয়ার যোগাড় | কোন রকমে চা বানানো ফেলে-‘মায়ের সুগার যাতে না বাড়ে সেজন্য ডাক্তার ওষুধ দিতে বলেছে‘ এই সব ভুজুঙ ভাজুঙ দিয়ে কোনরকমে সে যাত্রায় রেহাই পেলেও মনে কিন্তু একটা ভয় থেকে গেল ওর যে মৃদুলা কোনভাবে শুনে নেয়নি তো টুপুরের কথা ? তাহলে তো সাড়ে সর্বনাশ ! কত কষ্টে যে গুরুদেবের কৃপাতে ওর এই সুদিন ফিরেছে তা তো ওই জানে |
আজ অনেকদিন পর মৃদুলার জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছে সোমনাথ| আসলে অফিসে সম্পাদি এসেছিল শাড়ি বিক্রি করতে | সেখান থেকেই একটা বেছে দিলেন কল্যাণী দি। এই মেজেন্ডা কালারটা মৃদুলা কে দারুন লাগে | শাড়ি কিনে সারপ্রাইজ দেবার লোভে আজকে একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরলো ও | কিন্তু একি ? দরজায় বেল বাজলেও খুলছে না কেন? এই সময় মৃদুলা কোথায় গেল? হঠাৎ মনে পড়ল আজ টাপুর আর টুপুরের কম্পিউটার কোচিং ক্লাস আছে | নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে শাড়িটা যত্ন করে রেখে দিল তোষকের তলায়। স্নান করে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসতেই চোখে পড়ল গুরুদেবের পাউডারের প্যাকেট | বুকটা ধড়াস করে উঠলো | তবে কি ও ভুল করে প্যাকেট গুলো ফেলে রেখে গেছে টেবিলের উপর? না সে তো অসম্ভব ব্যাপার! ও দৌড়ে গেল যেখানে প্যাকেটগুলোকে রেখেছিল । সেগুলো তো ওখানেই আছে তাহলে এগুলো কোথা থেকে এল? তবে কি মৃদুলা ও ওকে এই পাউডার খাওয়াচ্ছে ? অর্থাৎ একই গুরুদেবের পাউডার ওরা দুজনই খাচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই সদর দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল| পাউডারের প্যাকেট গুলো লুকিয়ে ফেলে সোমনাথ | মৃদুলা বাড়ি ঢুকে সোমনাথ কে দেখে বেশ অবাকই হয়ে যায় কিন্তু কথা বন্ধ থাকাতে তাড়াতাড়ি ফেরার কারণটা জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারেনা| কিন্তু একি? কোচিং ক্লাস যাওয়ার আগে টেবিলে যে গুরুদেবের ওষুধ টা রেখে গেছিল,ভেবেছিল এসেই সরিয়ে রাখবে সেটা কোথায় গেল ? তবে কি সেটা সোমনাথের হাতে পড়ল ?
সোমনাথ ওর কেনা শাড়িটা বিছানার উপর রেখে বাথরুমে ঢুকলো । মৃদুলা ঘরে ঢুকলো জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হতে | হঠাৎই চোখ পড়লো শাড়িটার উপর | ম্যাজেন্টা কালারের শাড়িটা দেখে ওর চোখে জল এসে গেল | সত্যি যে স্বামী ওকে এত ভালবাসে–না বলতেই মনের মত শাড়ি কিনে দেয়,ভোরে উঠে ওকে চা করে দেয়,তাকে কিনা ও মঙ্গলার কথা শুনে গুরুদেবের পাউডার খাওয়াতে গিয়েছিল? ওই পাউডার খেয়ে যদি সোমনাথ মরে যেত তাহলে ওর কি হতো ? নিজের উপরই বড় ধিক্কার এল মৃদুলার| সোমনাথ বাথরুম থেকেই মৃদুলার ঘরে ঢোকার শব্দ টের পেয়েছিল। বাথরুমে দরজা খোলার পর কি প্রতিক্রিয়া হয় তার জন্য মনে মনে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বাথরুম থেকে বেরিয়ে কোথাও মৃদুলা কে দেখতে পেল না। ঘরের আলো আঁধারিতে পা বাড়াতেই টের পেল পায়ের তলায় ভারী কিছু কি জিনিস | কিছু বোঝার আগেই হাউমাউ করে কান্নার শব্দে সোমনাথ যারপর নাই হতচকিত হয়ে গেল |
” তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও |”
” সেকি ? কি হলো? ”
” তুমি আগে ক্ষমা করে দাও |” সোমনাথ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর পা দুটো চেপে ধরল মৃদুলা |
” কি হয়েছে বলবে তো ? ”
কান্না ভেজা গলায় মৃদুলা বলে,”আমি মঙ্গলার কথা শুনে গুরুদেবের ওষুধ তোমাকে খাওয়াবো বলে এনেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোমাকে সেই ওষুধ দিইনি,দিতে পারিনি। তোমার যদি কিছু হয়ে যেত তাহলে আমি নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারতাম না |”
সোমনাথের মনটা তোলপাড় করে ওঠে,যে ওষুধ মৃদুলা ওকে প্রাণে ধরে দিতে পারেনি ওর ক্ষতি হবে ভেবে অথচ ও তো সেই ওষুধ ই নির্দ্বিধায় ওকে দিয়ে চলেছে| একবারও তো মৃদুলার ক্ষতির কথা ভাবেনি, যে কিনা ওর দুই সন্তানের মা তার ক্ষতির কথা মনেই আসেনি ! ছি: ওর যদি কিছু হয়ে যেত ! মৃদুলার সহজ স্বীকারোক্তি সোমনাথকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে ও কতটা স্বার্থপর।
গলার কাছটা দলা পাকিয়ে ওঠে সোমনাথের|বহুদিন পর মৃদুলাকে কাছে টেনে নেয় সোমনাথ | বুকের ভেতর তোলপাড় করে ওঠা আছড়ে পড়া ঢেউ ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে। আর কোনদিন এত বড় অন্যায় ও করবে না | নতুন শাড়ির পাট খুলে সেই প্রথম দিনের মতো ঘোমটা দিয়ে দেয় মৃদুলাকে | পরম যত্নে মমতায় ওর মুখটা নিজের বুকে কাছে টেনে নেয় |
*******************************
ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷ এই পত্রিকাতেই তার লেখার পথ চলার শুরু।
দাম্পত্যের অম্ল মধুর সম্পর্কের এক স্পষ্ট ছবি আঁকলে
এইমাত্র পড়লাম।বেশ ছিমছাম,মিষ্টি আর ঝালে অম্বলে মেশানো দাম্পত্য প্রেম! ভালো হয়েছে।