Shadow

বিপন্ন বসুধা – আশিস দাস

PC Yorkshire evening post

বিপন্ন বসুধা

আশিস দাস

মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে ভেসে গেছে বেশ কয়েকটি প্রাণ !! ঘটনা উত্তরকাশীর ; কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আজকাল মাঝেমাঝেই এই মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে মৃত্যুর কথা শোনা যায় ; এরকম ঘটনা ঘটেছিল কয়েকবছর আগে পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডিতে I

প্রকৃতি চিরকালই এক পরম বিস্ময়,আজ সেই প্রকৃতি যেন আরো বিস্ময়কর হয়ে উঠেছে ; প্রকৃতির রুদ্ররূপ মানুষকে আতঙ্কিত করছে ; আজ প্রশ্ন উঠেছে যে ,শুধু শিশু নয়,আবালবৃদ্ধবনিতার পক্ষেও পৃথিবী কতদিন বাসযোগ্য থাকবে??

অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, ভয়াবহ তাপপ্রবাহভয়ঙ্কর দাবানল  ইত্যাদি অস্বাভাবিক  প্রাকৃতিক ঘটনা আজ পৃথিবীর প্রধানতম  সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে  : পৃথিবীর যে সব দেশ শীতল     আবহাওয়ার জন্যে পরিচিত,সেই সব দেশও উষ্ণ হয়ে উঠেছে

আজ ১লা জুলাই ,২০২৫  খবরের কাগজের রিপোর্ট যে “Heatwave singes from France to Turkey” | ফ্রান্স,পর্তুগাল, স্পেন, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ ভয়ঙ্কর তাপপ্রবাহের কবলে ; স্পেন এর মতো দেশে উষ্ণতা ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস , ফ্রান্স তাপপ্রবাহ কবলিততাপপ্রবাহের কারণে পর্তুগালের বিভিন্ন জেলায় জারি হয়েছেলাল সতর্কতা” |  জুন  মাসে এই দেশের উষ্ণতা পৌছেছিল ৪৬.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসে |  তুরস্কে দেখা দিয়েছে ভয়ঙ্কর  দাবানল | পরিস্থিতির ভয়াবহতা লক্ষ্য করে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব Antonio Guterres বলেছেন,” Extreme heat is no longer a rare event–it has become the new normal”; তিনি আরো বলেছেন যে,”The planet is getting hotter and more dangerous–no country is immune ” ; পৃথিবী উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে এবং কোনো দেশই এই অবস্থা থেকে মুক্ত নয় : পরিসংখ্যান  অনুযায়ী গত বছরেও ফ্রান্স,জার্মানী, নেদারল্যান্ড,বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে ছিল, উষ্ণতার কবলে পড়েছিল ব্রিটেনও ; এই অবস্থা অবশ্যই অভাবনীয় ; এই যদি ইউরোপের চিত্র হয় তাহলে ভারত, পাকিস্তান,আফগানিস্তানের মতো দেশের কি অবস্থা হবে ? কি হবে ইথিওপিয়ার

   একটা বিষয় খুব সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে যে পৃথিবী এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের  দিকে এগিয়ে যাচ্ছে l সমূহ ধ্বংসের বার্তা দিচ্ছে প্রকৃতি কিন্তু মানবসমাজ হয়তো সে বার্তা বুঝতে পারছে না অথবা বুঝতে চাইছে না ; মানুষ নিজের সুখের জন্যে প্রকৃতিকে নিরন্তর শোষন করেছে, নির্বিচারে বনজঙ্গল কেটে তৈরী করেছে কলকারখানা,গড়ে উঠেছে বসত, ইঁট, পাথর, কংক্রিটে ঢেকে গেছে মাটি,কারখানার ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আকাশের নীলিমা :

  “গাছগুলোকে কাটলে কি হয়

  তাও তো দেখছো তুমি,

  গাঁ গঞ্জ আর জীবন্ত নয়

  শুকনো মরুভূমি,

  হারিয়ে গেছে মাথার ওপর

  গাছের সবুজ পাতা,

    জ্বলছে বাজার,রাস্তা ঘর

  এই নাকি কোলকাতা !!” — না, শুধু কোলকাতার দৃশ্য নয়, দৃশ্য আজ সারা পৃথিবীর;পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠেছে,উষ্ণ হয়েছে সমুদ্রের জল যার জন্যে বহু সামুদ্রিক প্রাণী জল ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে আসছে,তুষার অঞ্চলের বরফ গলতে আরম্ভ করেছে; সবের ফল যে কি মারাত্মক হতে পারে তা সহজেই অনুমেয় | তাপমাত্রার অত্যধিক বৃদ্ধির ফলে ল্যাটিন আমেরিকা,কানাডা,অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন দেশের বিস্তির্ণ বনাঞ্চলে দাবানল সৃষ্টি হচ্ছে এবং মাইলের পর মাইল এলাকার গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে;শুধু তাই নয়, এই দাবানলের ফলে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে  এবং কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে আকাশ | এই দাবানল পৃথিবীতে যে পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইড সৃষ্টি করছে,সেই গ্যাস শুষে নেবার মতো সবুজ অঞ্চলের অভাব আছে পৃথিবীতে l আমাজন রেইন ফরেস্টের দাবানল  মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে আগামী দিন সত্যিই ভয়াবহ |

শিল্পবিপ্লবের পর থেকে  পৃথিবী যে গতিতে যন্ত্র সভ্যতার দিকে এগিয়ে গেছে হয়তো সেই গতিতেই পৃথিবী ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ; অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রা পদ্ধতিও বিশেষভাবে জড়িত | ফ্রিজ,এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদির ব্যবহার বাতাসকে বা বায়ুমন্ডলকে কলুষিত করছে,এই সব যন্ত্রে যে গ্যাস ব্যবহার হয়,যার নাম ক্লোরো ফ্লুরো কার্বন,যার বাজারি নাম Freon 12,সেই গ্যাস ওজোন স্তর নষ্ট করে দিচ্ছে | যার ফলে সূর্যে অতি বেগুনী রশ্মি সোজাসুজি পৃথিবীর বুকে চলে আসছে আর  জীবজন্তু মানুষের শরীরে ভয়ঙ্কর চর্মরোগ,এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত হচ্ছে | যানবাহনের অতিরিক্ত বৃদ্ধি,যুদ্ধ ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানী বা fossil fuel এর ব্যবহার বৃদ্ধি করেছে | বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে যুদ্ধবিগ্রহ চলছে  সেই সব যুদ্ধের অগ্রভাগে অবস্থান করে জীবাশ্ম জ্বালানী বা fossil fuel এর ব্যবহার,পেট্রোলিয়াম যে কোনো যুদ্ধেরই মূল নিয়ামক: যুদ্ধবিমান,ট্যাঙ্ক এসবই তো পেট্রোলিয়ামের সাহায্যে চলেদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রতিদিন একজন আমেরিকান সৈনিকের পেছনে এক গ্যালন পেট্রিলিয়াম ব্যবহার হয়েছিল,উপত্যকার যুদ্ধ বা gulf war সেই পরিমান প্রতিদিন সৈনিক পিছু চার গ্যালন হয়েছিল,পরবর্তী কালে ইরাক যুদ্ধে সেই পরিমান আরো বৃদ্ধি পেয়েছে;একটা F16 বিমান প্রতিঘন্টায় যে কি পরিমান পেট্রোলিয়াম ব্যবহার করে তা শুনলে অবাক হতে হয়; ছাড়াও যে কোনো সেনা অভিযানে প্রচুর পরিমান দূষিত পদার্থ বা toxic element বাতাসে এবং জলে মিশে গিয়ে ভয়ঙ্কর দূষণ সৃষ্টি করে | বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্যে উন্নত দেশগুলিকেই বেশী দায়ী করা হয় কারণ এই সব দেশ carbon economy ওপর বেশী নির্ভরশীল |
প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে সাম্প্রতিক কালে যে ভয়াবহ মহামারীর ফলে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হলো সেই মহামারী প্রথম দেখা দিয়েছিল বিশ্বের উন্নত দেশেই এবং মৃত্যু বেশী হয়েছে উন্নত দেশেই

আসলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে এই মহামারীর সঙ্গেও প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতার একটা সম্পর্ক আছে: বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে এই মহামারী আসলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়  বা environmental crisis এরই cognate phenomenon;প্রকৃতির ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার ফলে পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠছে, দাবানল ইত্যাদির জন্যে বনজঙ্গলে বসবাসকারী প্রাণীরা মনুষ্য সমাজের কাছাকাছি চলে আসছে;মনুষ্য জগত প্রানীজগতের মধ্যে ব্যবধান কমে যাচ্ছে;প্রাণীদেহে বসবাসকারী ভাইরাস যাকে zoonotic virus বলে সেইসব ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করছে যার ফল হচ্ছে মারাত্মক: সেদিক বিচার করলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাও  এই মহামারীর একটি অন্যতম  কারণ বলা যায় |

একটা কথা অবশ্যই বলতে হয় যে জলবায়ুর এই পরিবর্তন একদিনে হয়নি,বহু বছর ধরে এই প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রকৃতিকে এই ভয়ঙ্কর বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে মানুষই,অন্য কোনো জীব নয় | সুতরাং প্রকৃতিকে বাঁচানো সেইসঙ্গে মানব সমাজকে বাঁচানোর দায়িত্ব মানুষকেই নিতে হবে |

আজ সুইডেনের একটি স্কুল পড়ুয়া মেয়ে গ্রেটা থুনবার্গ সারা বিশ্বকে চমকিত করেছে! এই মেয়েটির প্রকৃতিকে বাঁচানোর আকুল আবেদনে বিশ্বের বিজ্ঞানী থেকে আরম্ভ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সবাই মোহিত হয়েছে;আজ বিশ্বের অনেকেই বলছে যে,ছোট মেয়ে গ্রেটা থুনবার্গ যে কথা বলছে,সে কথা আমাদের অনেক আগেই ভাবা উচিৎ ছিল | পৃথিবীর বুকে একসময়ে আরো অনেক প্রাণী ছিল,কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সেইসব প্রাণী নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি,তাই তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে; ইতিহাস মানুষ জানে কিন্তু সব জেনেও মানুষ সেইভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি;আজ সময় এসেছে শুধুমাত্র পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার জন্যেও মানুষকে সংযত হতে হবে,সচেতন হতে হবে,অন্যথায় ধ্বংস অনিবার্য্য।
***************************

আশিস দাস পরিচিতিঃ
জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণার ভাটপাড়ায়,শৈশব থেকেই কয়লাখনির শহর আসানসোলে বাস। পড়াশোনা আসানসোল, বর্ধমান ও কল্যানীতে। ইংরাজি সাহিত্যে M.A. ত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বিশ বছরই আসানসোল মহিশীলা বয়েজ’ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আধুনিক ইংরাজি কবিতার,বিশেষ করে W B Yeats ও T S Eliot এর পরম ভক্ত,ভালো লাগে ইংরাজি ও বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখতে,আর ভালো লাগে রবীন্দ্রসঙ্গীত।

 

1 Comment

Leave a Reply to Sankhadip Sengupta Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!