
স্মৃতির সরণি বেয়ে
চন্দ্র কান্তি দত্ত
অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরী হয়ে গেল। অনিমেষ কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটা দেখলেন। ছটা বেজে একচল্লিশ। বাসটা হয়তো পাওয়া যাবে না। অনিমেষ দেখেছেন, বাসটা সাধারণত সাড়ে ছটা থেকে ছটা চল্লিশের মধ্যে এ অঞ্চলটা পেরিয়ে চলে যায়। সে হিসেবে আজকে বাসটা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পরের বাস আসতে অন্ততঃ মিনিট দশেক লাগবে। অনিমেষ একটু এগিয়ে এসে ই–মলের সামনে দাঁড়ালেন। ইলেকট্রনিক সামগ্রীর পাঁচতলা একটা অত্যাধুনিক বাজার এই ই–মল। এরকম একটা আধুনিক বাজার থাকার ফলে জায়গাটা যতটা পরিস্কার ততটাই সুন্দর। বাস আসতে দেরী হলেও দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হয় না।
অনিমেষ যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার ঠিক উল্টোদিকে. রাস্তার ওপারে দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের দোতলা একটা রেস্তোরাঁ আছে। ওখানে নাকি খুব সুস্বাদু নোনতা লস্যি পাওয়া যায়। অনিমেষ মিষ্টি লস্যি পছন্দ করেন না। নোনতা লস্যিটা কেমন হয় একবার চেখে দেখলে হয়।কিছু একটা খাওয়াও দরকার। একটু ভেবেটেবে অনিমেষ সেখানে গিয়ে ঢুকলেন। একটা সরু ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে খাবার জায়গায় যেতে হয়। উপরে উঠে অনিমেষ প্রথমে একটা মশলা ধোসা ও তারপরে এক গেলাস নোনতা লস্যি চেয়ে নিলেন।
খাওয়া শেষ হলে দাম মিটিয়ে ফিরে আসার সময় ঘটনাটা ঘটল। সময়ের অভাবে অনিমেষ যখন দ্রুতগতিতে নামছেন, ঠিক সেই সময় সরু দরজা ঠেলে দুজন ভদ্রমহিলা ভিতরে ঢুকছেন। দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে অনিমেষ নিজেকে কোনক্রমে সামলে সরে দাঁড়ালেন। ওঁরা যদিও মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু ওঁদের ক্ষণিকের ধন্যবাদজ্ঞাপক মিষ্টি চাউনি অনেক কিছু প্রকাশ করে গেল। অনিমেষের কোন উদ্বেগ থাকল না। তিনি হৃষ্টচিত্তে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালেন।
বাসে উঠে বসার জায়গা পেলেন না অনিমেষ। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত আগের একটা সুন্দর ঘটনার পরে মনটাকে এরকম দমিয়ে দেওয়ার মত ঘটনা না ঘটলেও পারত। অনিমেষ একটা আরামদায়ক জায়গা খুঁজছিলেন দাঁড়াবার জন্য। হঠাৎ পরের স্টপেজ, মানে ধর্মতলা আসার আগেই একটা সিট খালি হয়ে গেল। অনিমেষ নেমে যাওয়া যাত্রীকে মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পড়লেন।
আজকে দিনটা অনিমেষের খুব ভাল কাটেনি। বসের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। তবে বাকি সময়টা যেমনই হোক, দিনের শেষটা বেশ সন্তোষজনক, ভাবছিলেন অনিমেষ। ভাবনাটা বাধা পেল রেস্তোরাঁর দরজায় গিয়ে। এক পলকের জন্য দেখা দুটো মুখ। তারই মধ্যে একটা যেন কেমন চেনা। আরে! প্রায় লাফিয়ে উঠলেন অনিমেষ। ভাবনারা যেন সোনালী ডানায় ভর করে হাওয়ায় উড়তে লাগল। চেনা চেনা কি? এ তো সে–ই। এ–ই তো সঞ্চারী। অনিমেষ প্রথমে আপ্লুত। পরমুহূর্তেই আবার সন্দিহান। এ কি করে সঞ্চারী হবে? ব্যবধান তো অনেকগুলো বছরের। বয়সের সাথে সাথে সবার চেহারায় স্বাভাবিকভাবেই নানান পরিবর্তন আসে। অনিমেষেরও এসেছে।
পুরোনো বন্ধুরা সহজে চিনতে পারবে না। কিন্তু কই? সঞ্চারীর তো কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। তবে কি সত্যিই এ সঞ্চারী নয়? সুদীর্ঘ সময় পেরিয়ে গিয়েছে। অনেকগুলো বছর।এইজন্যই অনিমেষের এত সন্দেহ। ব্যবধান যে সত্যিই অনেক বছরের।
অনিমেষ তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। লম্বা সুগঠিত চেহারা। হালকা শ্যামলা গায়ের রং। কিছুটা অন্তর্মুখী, বয়সের তুলনায় একটু বেশী গম্ভীর। প্রথম বর্ষের শেষের দিকে এসেও সহপাঠী বন্ধুর সংখ্যা পাঁচ কি ছয়। সংখ্যাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। কারণ, ক্লাসের বাহান্নজন ছেলেমেয়ের মধ্যে মাত্র এই কজনের সাথেই অনিমেষ মাঝে মাঝে গল্পগুজব করে। এছাড়া আর একজনের সাথেই অনিমেষ স্বচ্ছন্দ। সে বাল্যসখী নীলু।
সঞ্চারীর সাথে অনিমেষের বন্ধুত্ব হয়েছিল বেশ নাটকীয় ভাবে। সেদিন, তখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে চারটে। কলেজে ভাঙ্গা হাট। অনেকেই বাড়ির পথে হাঁটা দিয়েছে। অনিমেষ অঙ্কের একটা গাইড বই নিয়ে ডিফারেন্সিয়াল ইক্যুয়েশনের একটা চ্যাপটার থেকে কিছু নোট নিচ্ছে। হঠাৎ শুনতে পেল পাশ থেকে কোন মেয়ে বলছে, “এই যে মারফি বয়, অত পড়াশোনা ভাল নয়। বাড়ি বলেও একটা পদার্থ আছে।” অনিমেষকে যে কেউ কেউ ‘মারফি বয়‘ বলে, এটা ওর কানে এসেছে। খবরের কাগজে মারফির যে বিজ্ঞাপন বেরোয়, তাতে একটা ছোট ছেলের মুখ থাকে। বড় বড় চুল, গালে একটা আঙ্গুল ঠেকানো। এই ছেলের মুখের সাথে নাকি অনিমেষের মুখের মিল আছে। এই ধরনের কোন মিল অনিমেষ নিজে খুঁজে পায় নি। অন্য কেউ কি করে এটা আবিষ্কার করলো সেটা ও জানে না। যা–ই হোক, মারফি বয় ডাকটা শুনে অনিমেষ মুখ তুলল। দেখল, সঞ্চারী প্রায় ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ও একটু অস্বস্তি বোধ করল। সঞ্চারী সেটা বুঝতে পেরে বলল, “কি রে! সঞ্চারী কথা বলছে বলে একেবারে অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা যে! নে নে, তুই খুব ভাল ছেলে এটা সবাই জানে। অত পড়াশোনা না করলেও চলবে। এখন ওঠ। আজকে বিকেলের বাসটা বন্ধ থাকবে। আমাদের সবাইকে ঘড়ি মোড় পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। আমি ওই গড় জঙ্গলটা একা পেরিয়ে যেতে পারব না। তুই সাথে থাকলে পারব। তুই তো ওই দিকেই থাকিস। চল চল, ওঠ।“
অনিমেষ বই বন্ধ করে ব্যাগ গুছিয়ে নিল। বলল, “এক মিনিট দাঁড়া। বইটা ফেরত দিয়ে আসি।“
অনিমেষ দেখল, বাস বন্ধ থাকায় শুধু ওরা দুজন নয়, অনেকেই গড় জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। সঞ্চারীকে একা যেতে হতো না। ও বুঝতে পারল না সঞ্চারী কেন একা যাওয়ার কথা বলল। ক্লাসে এত ছেলেমেয়ে থাকতে কেনই বা ওকেই তুলে আনল? এই বয়সের মেয়েগুলোকে বোঝা বড় কঠিন।
এরকম নাটকীয় ভাবে যে বন্ধুত্বের সূচনা, তা গভীর হতে বেশী সময় লাগেনি। একই সাথে ক্লাস করা, একসাথে টিফিন খাওয়া, একসাথে অন্যদের সাথে আড্ডা দেওয়া। সঞ্চারী ও অনিমেষ অচিরেই পরস্পরের অত্যন্ত প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল। ভুল বোঝাবুঝি কি হয়নি? হয়েছিল। অনেকবার। অনিমেষের আজও মনে পড়ে টুকরো টুকরো কিছু ঘটনার কথা। ছোট ছোট কিছু কথার ভুল মাঝে মাঝে দুজনের মধুর সম্পর্কের মাঝে পলকা দেওয়াল তুলত। হয়ত দু–এক দিনের জন্য কথাও বন্ধ থাকত। তারপর কেউ একজন আপস করে নিত। একটা ঘটনা মনে পড়ায় অনিমেষ মনে মনে হাসলেন। ঘটনার রেশ প্রায় দিন দশেক চলেছিল সেবার। ঘটনাটা নীলুকে নিয়ে।
নীলাম্বরী ওরফে নীলু। অনিমেষদের প্রতিবেশী সেনকাকুর মেয়ে। ওদের বাড়িটা ছিল অনিমেষদের দুটো বাড়ি পরে বড় রাস্তার দিকে। পাড়ার আরও অন্যান্য ছেলেমেয়ের সাথে মিলেমিশে বড় হচ্ছিল ওরাও। অনি ও নীলু একই বয়সী। একসাথে এক স্কুলে পড়েছে। একই প্রাইমারী স্কুল, একই হাই স্কুল আবার একই কলেজ। শুধু কলেজে এসে দুজনের বিষয় আলাদা হয়ে গেছে। নীলুর সাথে অনির মনের কোন গোপন সম্পর্ক নেই। সামাজিক সম্পর্কে ওরা পাড়াতুতো ভাইবোন। ছেলেবেলা থেকে ভাব ভালবাসা যেমন থেকেছে, মারামারি ঝগড়াঝাঁটিও তেমনি অনেকবার হয়েছে। এখন কলেজে যাওয়ার সময় সকালে যে আগে তৈরী হয় সে অন্যজনকে ডাকতে আসে। দুজনে একসাথে আধ মাইল মত হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে আসে। একই বাসে কলেজে আসে। তবে রোজ একসাথে ফেরে না। প্রথমতঃ, দুজনের একসাথে ক্লাস শেষ হয় না। দ্বিতীয়তঃ, বাপ্পা প্রায়ই মোটরসাইকেল নিয়ে নীলুকে নিতে আসে। বাপ্পা নীলুর বয়ফ্রেন্ড। পাশের লিচুবাগানে থাকে। অনি ও বাপ্পা পরস্পরকে চেনে। নীলুও অনির কাছে কিছু লুকোয় না।
একদিন কলেজে আসার পরপরই কোন একটা কারণে নীলুকে ক্ষ্যাপানোর জন্য অনি কিছু একটা কথা বলেছিল। এত বছর পরে অনিমেষ আর সেকথাগুলো মনে করতে পারলেন না। যাই হোক, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নীলু অনির পিঠে গুম গুম করে দুটো কিল মেরে দিয়েছিল। দূর থেকে সঞ্চারী সেটা দেখতে পায়। ব্যাস। এতেই একটা নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে যায়। সঞ্চারী অনিমেষের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। অনিমেষ কথা বলতে গিয়ে বাধা পায়। সঞ্চারী কথা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু কেন? অনিমেষ কারণটা বুঝতে পারে না। অন্তর্মুখী অনিমেষ নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
অনিমেষের স্পষ্ট মনে আছে সঞ্চারী প্রায় দশদিন অনিমেষের সাথে কথা বলেনি। শেষে একদিন নীলুর উদ্যোগে ভুল বোঝাবুঝি মেটে। নীলু কিছু একটা আঁচ করে একদিন অনিকে জিজ্ঞাসা করে, “হ্যাঁরে অনি? সঞ্চারীকে তোর সাথে দেখছি না কেন? কিছু হয়েছে?”
অনিমেষ একটু চুপ করে থেকে তারপর বলল, “জানিনা কি হয়েছে। দেখছি তো কথা বলছে না।“
নীলু অবাক হল, “কি বললি? জানিস না? সেকি রে? গলায় গলায় ভাব। সেখানে বেশ কয়েকদিন কথাবার্তা নেই। জানার চেষ্টা করিস নি?”
“না“, অনি জবাব দিল, “আমি বোকাসোকা মানুষ। তোদের মেয়েদের মন বোঝার ক্ষমতা আমার নেই রে। কোন দোষ করেছি বলে তো মনে পড়ছে না।“
অগত্যা নীলুই দায়িত্ব নিল। সোজা সঞ্চারীর কাছে গিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করে বসল। নীলুকে দেখে সঞ্চারী আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। বলল, “সবই তো জানিস। জেনেশুনে আবার ন্যাকামো করছিস কেন। যা না তোর প্রিয় বন্ধুর কাছে।“
নীলু হেসে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ হাসল। যখন দেখল সঞ্চারী হিংসেয় প্রায় জ্বলে যাচ্ছে তখন হাসি থামিয়ে বলল, “ওরে, ওই দুষ্টু ছেলেটা পাঁচ বছর বয়স থেকে আমার কাছে ভাইফোঁটা নেয়। আমরা দুজন জন্ম থেকে পাশাপাশি বাস করি। তুই ওকে কতটুকু চিনিস? আমার মত নিশ্চয় নয়? যতসব ছেলেমানুষী কান্ড। চল।“
সময় ক্রমশঃ গড়িয়েছে। দেখতে দেখতে তিনটে বছর কোনদিক দিয়ে পার হয়ে গেছে বোঝা যায় নি। মন যাকে প্রতিদিন চোখে হারাতো, সময় এসেছে তার কাছ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার। অর্থাভাবে অনিমেষের আর পড়ার কোন উপায় ছিল না। রোজগারের চেষ্টায় নামতে হয়েছে। অন্যদিকে সঞ্চারী উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে গেছে। অনিমেষের সাথে যোগাযোগ চিরতরে ছিন্ন হয়ে গেছে কলেজের শেষ দিন থেকেই। আর কোনদিন দেখেননি সঞ্চারীকে। কারও কাছে কোন খবরও পাননি।
স্টপেজ এসে গিয়েছে। অনিমেষ বাস থেকে নামলেন। চারিদিকে কেমন অন্ধকার। লোডশেডিং হল কি? তা কি করে হবে? এখানে তো এসব হয় না। হয়ত কোন ফল্ট হয়েছে। অনিমেষ মোড়ের দোকান থেকে একটা মোমবাতি আর এক বাক্স দেশলাই কিনলেন।
অজয়দা চা বানিয়ে দিয়েছে। অনিমেষ চা নিয়ে ঝুল বারান্দায় বসলেন। স্মৃতি সততঃ বেদনার। আজ সন্ধ্যেবেলা রেস্তোরাঁয় দেখা রমনী সঞ্চারী হোক বা না হোক, তার স্মৃতি আজ বড় উজ্জ্বল ভাবে ফিরে এসেছে। অনিমেষ মনে একটা হালকা ব্যথা অনুভব করলেন হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর জন্য। সঞ্চারী। অনিমেষের জীবনের একটা অধ্যায়। আরো ভাল করে বলা যায় একটা অসম্পূর্ণ অধ্যায়, যাকে ভাবার কোন অর্থ আজ আর নেই।
*****************************
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে,তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও,শারীরিক অসুস্হতার কারণে লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন,চাকরী থেকে অবসরের পরে,প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।
আপনার গল্পঃ গুলোর একটা আলাদা স্বাদ আছে। একটা লাইন পরের লাইনে টেনে নিয়ে যায়। পূজোর শুভেচ্ছা।