জ্যোতির্লিঙ্গ কেদারনাথ
বিজিত কুমার রায়
“ঐ যে দেখা যায় কেদারনাথধাম — মন্দাকিনীর ওপারে
যেথা শান্ত হইবে চরণ যুগল — তৃপ্ত হবে মন প্রাণ
দীর্ঘ বাসনা পূরণ হইবে — জপ জপ শিব নাম ।
আমাদের স্বর্গারোহন শুরু হয়েছিল গৌরীকুন্ড থেকে। তার আগের পথটুকু এসেছিলাম হরিদ্বার থেকে বাসে কলকাতার একটি ট্র্যাভেলস এর সাথে। তারপর গৌরীকুণ্ডে রাত্রিবাস করে পরদিন রওয়ানা বাবার ধামের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ ১৪ কিমি পাহাড়ি রাস্তা ভেঙে ১১৭৫৩ ফুট ওপরে বাবার মন্দিরে উঠতে হবে। রাস্তাও সেই ভাবে সুষ্ঠু ভাবে বাঁধানো নয়। অবশ্য আমরা গিয়েছিলাম ২০০৯ সালে। এখন তো সেই রাস্তাই আর নেই, আরো নেই সেই গৌরীকুন্ডের জনপদ।
ঐ যে বলেনা তুমি যাও বঙ্গে, তোমার কপাল যায় সঙ্গে। আমাদের তাই দশা হলো। ভোরবেলা আগের দিন ঠিক করে রাখা পনি পাওয়া গেলোনা কারণ নাকি ঘোড়ার মড়ক লেগেছে। তাই কিছুটা চৌদোলাতে আর কিছুটা পদব্রজে যাত্রা। যাত্রার দীর্ঘ বিবরণ দেওয়ার ইচ্ছা নেই। তবে এটুকু লিখি যে ওপরে ওঠার রাস্তা ভালো ছিলোনা আর বেশ কষ্টকর আমাদের বয়সে (৫৭, ৫২ আর ৬৫, আমি, গিন্নী আর মেয়ের শ্বাশুড়ীমা)। সাথে ছিলো ৩০, ২৭ আর ২৪ এর দুই মেয়ে ও জামাই। ওরা গিয়েছিল মহানন্দে পদব্রজে। এখন তো সে রাস্তাই ধুয়ে মুছে গিয়েছে।
শেষের দিকে প্রায় ৪টা বৈকালে আমরা রামবাড়া চটিতে পৌঁছালাম। রাস্তায় মুষলধারে বৃষ্টিতে রেইনকোট থাকা সত্ত্বেও ভিজে একশা। চা খেয়ে গরম হওয়ার পর আবার যাত্রা শুরু। এরপর গরুড় চটি পেরিয়ে দেও দেখানি। এরপর সোজা রাস্তা ১.৫ কিমি। সামনে মন্দিরের চূড়া আর তিনদিকে উঁচু পাহাড়, সবচেয়ে উঁচু কেদার পাহাড় ২২৭০০ ফুট।
জয় কেদারনাথের দোহাই দিয়ে পৌঁছালাম মন্দির পরিসরে। মাঝে মন্দির ঘিরে দোকানের সারি আর তার পিছনে ছোট ছোট চটি বা লজ। আমরা পৌঁছালাম ভারত সেবাশ্রমের গেস্ট হাউসে মন্দিরের পেছন দিকে (এখন আর নেই)। পৌঁছে দেখি আমাদের বয়স্কতমা সদস্যা একটা বড় ঘরের (৮ বেড) ব্যবস্থা করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ঘরে পৌঁছে ভিজা জামা কাপড় বদলে পরিষ্কার হয়ে সোজা দৌড় মন্দিরে বাবার দর্শনে আর আরতি দেখতে।
ভিড় না থাকাতে সোজা মন্দিরের পরিসরের ভেতরে। আগাগোড়া পাথরের মন্দির। মন্দিরের চাতাল থেকে কিছুটা উঁচুতে রেলিং দিয়ে ঘেরা আয়তাকার ক্ষেত্র। নাটমন্দির ছোট। তার সামনে বড়ো দরজা। দুই পাশে দুই পাথরের দ্বারপাল দন্ড হাতে দাঁড়িয়ে। মন্দিরে ঢোকার মুখে উত্তরমুখী বিশাল কালো পাথরের নন্দী। তাঁকে প্রণাম জানিয়ে মন্দিরে ঢোকা। গর্ভ মন্দিরের চূড়া দেউলাকৃতি। তার ওপর নেপালী ঢঙের ছত্রী। একদম ওপরে স্বর্ণকলস। মন্দিরে ঢুকেই উঁচু বেদীর ওপরে দেবতার দিকে মুখ করে পিতলের ছোট নন্দী। তার সামনে কেদারনাথের পঞ্চমুখী শিবমূর্তি। তাঁকে প্রণাম করে গর্ভমন্দিরের ভিতরে প্রবেশ। ভিতরে বিশালকায় পিতলের প্রদীপ তাতে অখণ্ড জ্যোতি জ্বলছে। এই জ্যোতি থাকে শীতকালে ছয়মাস মন্দির বন্ধের সময়েও।
ঠিক মাঝখানে পাথরের রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গায় কালো পাথরের ত্রিকোনাকৃতি এবং একটা দিক ঢালু হয়ে নেমে আসা প্রায় আড়াই হাত উঁচু পরম আরাধ্য জ্যোতির্লিঙ্গ কেদারনাথ। রাস্তার কষ্ট, তীব্র ঠান্ডা, সব মন থেকে চলে গেলো প্রথম দর্শনে। পূজা দিয়ে বাবার শ্ৰী মূর্তি স্পর্শ ও আলিঙ্গন করে মনের সাধ মেটালাম আমরা।
আমাদের দর্শনের পরে পান্ডাজীরা সান্ধ্য আরতির জন্য মন্দির ও বিগ্রহ পরিষ্কারের কাজ শুরু করলেন। আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম আরতি দর্শনের আশায়।
আরতির ঘন্টা বাজা শুরু হলো। কালো জামাকাপড় পড়ে রাওয়াল পূজারীরা আরতি শুরু করলেন। তালে তালে বিচিত্র সুরে স্তব ও পাঠ চলতে লাগলো। সমবেত ভক্তরা জয়ধ্বনি দিয়ে উঠতে লাগল। অপরূপ মনোহর দৃশ্য। আরতির আগে শৃঙ্গার করা হয়েছে। সুন্দর বেনারসী কাপড় দিয়ে সমগ্র লিঙ্গটি ঢেকে তার ওপর দামী শাল জড়িয়ে, ওপরে রূপার মুকুট, তার ওপর সর্পছত্র, আর অনেক মালা দিয়ে সাজানো।
প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। আমাদের ঘরে ফিরে এলাম। গরম জলে হাত মুখ ধুয়ে কম্বল জড়িয়ে বসা হলো। ট্র্যাভেলস থেকে গরম পাকোড়া আর কফি দিয়ে গেলো। পান্ডাজী এলেন পরের দিন ভোর বেলার বিশেষ পূজার ব্যবস্থা করতে। রাত ৯টা নাগাদ খাবার ঘরে গিয়ে গরম খিচুড়ি, আলুভাজা ও পাঁপড় ভাজা দিয়ে রাত্রি ভোজ সারা হলো। ওই ঠাণ্ডাতে রান্নাঘরের পাশে বেঞ্চিতে বসে মনে হলো অমৃত খেলাম।
পরদিন ভোর বেলা উঠে ঠান্ডা জলেই কোনোমতে কাকস্নান সেরে মন্দিরের পাশে লাইনে দাঁড়ালাম ৪টার সময়ে, মন্দিরে প্রবেশের জন্য। হাড় কাঁপানো শীত। (পরে জেনেছি – ২℃)। মন্দিরে প্রবেশ হবে সকাল ৫.৩০ মিনিটে। আমরা যখন দাঁড়িয়েছি মন্দিরে গা ঘেঁষে লাইনে তখনো সূর্যোদয় হয়নি। বিরাট কেদার পাহাড় বরফাবৃত। তবে সূর্যের আলো না ফোটায় ধূসর দেখাচ্ছে যেন ভস্মবিভূষিত দেহ। মাঝখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে মন্দাকিনী। কিছুক্ষন পরে একটা সরু লালচে আলোর রেখা এসে পড়লো কেদার চূড়ায়। যেন কেউ সিঁদুরের ফোঁটা পরিয়ে দিলো, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো ওপর থেকে আশে পাশে। এবার ধীরে ধীরে কেদার পর্বত তার ধূসর বর্ণ সরিয়ে নিয়ে রজতগিরি রূপ নিতে লাগলো । ভস্মবিভূষিত মহাদেব যেন সদ্য স্নান সেরে তাঁর গৌরকান্তি রজত ধবল রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করলেন। অপূর্ব মনমুগ্ধকর দৃশ্য। ভাষায় বর্ণনা আমার সাধ্যের অতীত ও ছবি তোলার কোনো উপায় নাই ক্যামেরা ছাড়া আসায়। ৫.৩০টার সময় মন্দির প্রবেশ হলো ও পান্ডাজীর নির্দেশ মতো পূজা সম্পন্ন হলো। অন্যদের পূজা করার জায়গা ছেড়ে আমরা বাইরে এলাম।মন্দির পরিক্রমা করা হলো। ঠিক পেছন দিকে দুইটি ছোট কুন্ড, হংসকুন্ড ও রেতস কুন্ড। আর আছে অমৃতকুন্ড। যার মধ্যে দুইটি স্ফটিক লিঙ্গ। এছাড়া আদি শঙ্করাচার্যের সমাধি আছে। আমাদের তোলা ২০০৮ সালের ছবি দিচ্ছি মন্দিরের ও মন্দিরের পিছনের। দেখলেই বুঝতে পারবেন কত তফাৎ হয়ে গিয়েছে। সমাধিটির বোধহয় একটি ভগ্নাংশ টিঁকে আছে ভীমশিলা (যেটি পরে এসেছে) ও মন্দিরের মাঝে। আর বোধহয় কিছুই নেই মন্দিরের পিছনের ও পাশের চারিদিক ঘিরে।
সেই সময়ের ক্যামেরাতে তোলা কয়টা ছবি দিলাম আর সঙ্গে এখন যারা গিয়েছেন তাদের তোলা কিছু ছবি দিলাম (শুধু তফাৎ দেখাবার জন্য)। আর কেদারনাথের ছবি নেট থেকে।
খাড়া কেদার পাহাড় সাদা বরফে ঢাকা, আর নীচে বয়ে চলেছে খরস্রোতা মন্দাকিনী। মন্দাকিনী দর্শন করাও হলো। মাথায় সেই হিমশীতল জলের স্পর্শ নিলাম।
এবার আমাদের ফেরার পালা। আবার সেই ১৪ কিমি পার্বত্য রাস্তা। খুঁজে পাওয়া গেলো সেই চৌদোলা ধারীদের। তাতে বসে আমাদের যাত্রা আর ছোকরা ছোকরিরা হেঁটে।
শিব দিগম্বর ভস্মধারী অর্ধচন্দ্র বিভূষিতম।
শীষ গঙ্গা কণ্ঠ নাগপতি জয় কেদার নমাম্যহম।।
কর ত্রিশূল বিশাল ডমরু জ্ঞান গান বিশারদম।
যক্ষ কিন্নর নাচ গাবে জয় কেদার নমাম্যহম ।।
নাথ পাবক হে বিশালম পুণ্যপ্রদ হরদর্শনম।
জয় কেদার উদার শংকর পাপ হর নমাম্যহম।।
“জয় কেদারনাথের জয়।।”
***********************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি:
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। ভেল (BHEL) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। দেশ বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহিত হয়ে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত। ।
চমৎকার লেখা । আমার যাওয়া হয়নি । লেখাটা পড়ে ভ্রমণের আনন্দ পেলাম ।
ধন্যবাদ, বিজিত ।
জয় বাবা কেদারনাথ 🙏
শেষের শ্লোকটি ভারী চমৎকার।