ইতিহাসের কোচ হাজো ও মীর জুমলা
সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়
৬০০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মণের জীবনকাল । গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের সঙ্গে যুদ্ধে কামরূপের বাহিনী পরাজিত হয় এবং ভাস্কর বর্মণ ও তাঁর দাদা সুপ্রতিষ্ঠিত বর্মণ বন্দী হন । ইতিহাস নিজের খেয়ালে এগিয়ে চলে,তাঁরা মুক্তি পান। বাবা এবং দাদার অকাল মৃত্যুর পর কামরূপের সিংহাসনে বসেন কুমার ভাস্কর বর্মণ। প্রায় কাছাকাছি সময়ে থানেশ্বর রাজ রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের হাতে নিহত হন এবং থানেশ্বরের রাজা হন রাজ্যবর্ধনের ভাই হর্ষবর্ধন। টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি,উত্তর ও পূর্ব ভারতে যুদ্ধের দামামা। ভাস্কর বর্মণ, হর্ষবর্ধনের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করেন এবং দু’জনের একই শত্রু ছিলেন গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক। ভাস্কর বর্মণ,হর্ষবর্ধন,শশাঙ্ক সকলেই হিন্দু (শৈব) ছিলেন,পরবর্তী কালে হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগী হয়ে পড়েন। রাজা হর্ষবর্ধনের রাজধানী কনৌজ,গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণ সুবর্ণ এবং ভাস্কর বর্মণের রাজধানী ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর। শশাঙ্কের মৃত্যুর কিছু বছর পর বাংলায় পাল রাজাদের শাসন চলে কয়েক শত বছর ধরে,গৌড় তাঁদের রাজধানী ছিল। তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগী ছিলেন এবং ধর্মপাল,দেবপাল উত্তর ভারতে অনেক দূর পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। নালন্দা বৌদ্ধ বিহারের বেশ কিছু সংস্কার ও নির্মাণ তাঁদের আমলে হয়েছিল। এই সময়ে সমগ্র বাংলা ও আসামের কিছু অঞ্চলেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার হয়েছিল।
হঠাৎ এত প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে আলোচনার কারণ আমরা বঙ্গাইগাঁও থেকে গোয়ালপাড়া ও তার কাছাকাছি শ্রী শ্রী সূর্য পাহাড় দেখতে চলেছি। কনৌজ,কর্ণ সুবর্ণ,গৌড় এর অবস্থান ঐতিহাসিকদের গবেষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ির ফলে মোটামুটি আন্দাজ করা গেছে। প্রাগজ্যোতিষপুর ঐতিহাসিকদের মতে,কামরূপ গুয়াহাটি অঞ্চলেই ছিল। কিন্তু গুয়াহাটি থেকে ১৩২ কিমি উত্তর পশ্চিমে এবং গোয়ালপাড়া থেকে ১২ কিমি দক্ষিণ পূর্বে সূর্য পাহাড় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় খনন কার্য চালিয়ে সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন পাওয়ার পর এবং এই এলাকা ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে হওয়ার ফলে কিছু কিছু ঐতিহাসিকের ধারণা সূর্য পাহাড় ও সন্নিহিত অঞ্চল প্রাচীন প্রাগজ্যোতিষপুর হতেও পারে। ইতিহাস বড় গোলমেলে,বিচিত্র তার গতিপথ। সময়ের সঙ্গে বহু রাজবংশের উথ্থান ও পতন হয়েছে এবং বারবার রাজ্যের সীমা ও রাজধানী বদল হয়েছে। সঠিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া বেশ শক্ত। যাই হোক সূর্য পাহাড়ের সঠিক ইতিহাস লেখার দায় ঐতিহাসিকদের,প্রমাণ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে এবং যুক্তি সাজিয়ে তাঁরা তা লিখছেন বা লিখবেন। আমাদের মতো ছাপোষা মানুষের অত তত্ত্বে দরকার নেই,আমরা বরং ঘুরে আসি গোয়ালপাড়া ও সূর্য পাহাড়।
হাওড়া থেকে ছেড়ে আসা আপ সরাইঘাট এক্সপ্রেসে শনিবার সকাল সাড়ে ছটায় যখন নিউ বঙ্গাইগাঁও স্টেশনে নামলাম,গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ছোট ছোট টিলায় ঘেরা সমতলের ওপর বঙ্গাইগাঁও ছিমছাম ছোট শহর। রাস্তা প্রশস্ত ও সুন্দর,প্রায় ১৪ বর্গ কিমি আয়তন ও লোকসংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। নিউ বঙ্গাইগাঁও জংশন রঙ্গিয়া ডিভিশনের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ জংশন স্টেশন। রেলের বড় একটা ওয়ার্কশপ আছে এখানে। আছে ইন্ডিয়ান ওয়েলের রিফাইনারি। কাছাকাছি আছে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অফিস, শপিং মল ও মাল্টিপ্লেক্স আছে বঙ্গাইগাঁও শহরে। হোটেল সি কে তে উঠে ফোন করলাম বন্ধু ও সহকর্মী স্বাগতকে। একটু বিশ্রাম নিয়ে ফ্রেশ হয়ে স্বাগতর স্কুটিতে চড়ে ঘুরে দেখলাম বঙ্গাইগাঁও এবং নিউ বঙ্গাইগাঁও। মাঝে রেল লাইন যার উপরে সুন্দর একটি ফ্লাই ওভার রয়েছে। ফ্লাই ওভার পেরিয়ে একটু যাওয়ার পর ঝমঝম বৃষ্টি। আধঘন্টা দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। স্বাগতর চাপাচাপিতে এখানের মৌচাকের দই বড়া ও সিঙ্গারা চেখে দেখতে হল। মুখে দিয়েই বুঝলাম বঙ্গাইগাঁও এর মৌচাক গোল পার্কের মৌচাকের চেয়ে খুব পিছিয়ে নেই। বাগেশ্বরী মন্দির,বীরঝোরা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল (দেওয়াল ট্রেনের কামরার আদলে রং করা .. যেন বীরঝোরা এক্সপ্রেস),ভগ্নপ্রায় প্রসার ভারতী অফিস,এস পি অফিস, ডি সি অফিস,সন্ন্যাসী পাহাড়ে শ্রী শ্রী মুক্তি নাথ সিদ্ধ যোগ আশ্রম,অভয়াপুরী গণেশ মন্দির (এটিও কয়েক শ বছরের পুরনো),রাজবাড়ি (ব্যক্তিগত সম্পত্তি,ভেতরে প্রবেশ নিষেধ তাই বাইরে থেকে দেখা)…সব ঘুরে দেখে হোটেলে ফিরে আসা,রাতটুকু কাটানো।
পরদিন রবিবার কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও “বেশ করবো শুয়ে থাকব …” সে উপায় নেই । BCKV র জুনিয়র এবং কলিগ বিশ্বনাথ প্রস্তাব দিয়েছে গেলেফু যাওয়ার। বঙ্গাইগাঁও থেকে প্রায় ৮০ কিমি দূরে ভুটানের এক প্রবেশ তথা বাণিজ্য পথ গেলেফু। এর পশ্চিমে ফুন্টশোলিং এবং পূর্বে সামদ্রুপ জংখার আরও দুটি প্রবেশ পথ যা দিয়ে দুই দেশের বাণিজ্য হয়। বলাই বাহুল্য এই প্রস্তাবে না বলার কোন কারণ নেই,রবিবার হলেও নেই। সকাল ৯-১৫ এর মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। শতকরা ৮০ ভাগ রাস্তা অত্যন্ত সুন্দর,মসৃণ ও সবুজে ঘেরা কিন্তু শেষ ২০ ভাগের অবস্থা শোচনীয়…প্রাণটা ছানা হয়ে বেরিয়ে আসার মতোই প্রায়। বহু কষ্টে পৌঁছনো গেল হাতিসারে (জায়গার এমন নামকরণের কারণ হাতির প্রাচুর্য) এক বড় গেট,ওপরে অশোক স্তম্ভের চার সিংহ ধন্যবাদ জানাচ্ছে। ওখান থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ..পৌঁছলাম গেলেফুর ভুটান গেট…এখনও লক ডাউনের জন্য বন্ধ। অগত্যা হতাশ হয়ে ফিরে আসা….আবার সেই এবড়ো খেবড়ো রাস্তা। ফেরার পথে এক সাম্পা নামে পাহাড়ি নদীর তীরে বেশ খানিকটা সময় কাটানো যেন একটু রিলিফ,মাথার ওপরে গনগনে সূর্য থাকা সত্ত্বেও। অনেকটা লাটাগুড়ির মূর্তি নদীর মতোই লাগে,ওই রকম ছোট একটা ব্রীজ কিন্তু আরও নির্জন,একটাও রিসর্ট চোখে পড়ে নি। নদী পার হয়ে আরও কিছুটা রাস্তা খারাপ,তারপর অপূর্ব।
প্রায় পৌনে তিনটেয় হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সারতে সারতে সাড়ে তিনটা। গেলেফু গেট বন্ধ থাকায় বিশ্বনাথের মন ভরে নি,তাই এবারে ঠিক হলো বিকাল সাড়ে চারটায় আমরা আবার বেরোব,তামারঙা লেক দেখতে। এই লেক বা বিল বঙ্গাইগাঁও থেকে প্রায় ২৫-২৬ কিমি দূরে। অস্ত গামী সূর্যের আলোয় গোটা লেকের জল লাল দেখায়,তামাটে লাল রঙের জন্য লেকের নাম তামারঙা। বাবু যায় বঙ্গে,কপাল যায় সঙ্গে! চারটা পর্যন্ত সূর্যের প্রখর রোদ অথচ সাড়ে চারটায় সূর্য মেঘের আড়ালে! হতোদ্যম হলেও যাত্রা শুরু হলো। পথে লেভেল ক্রসিং এ ট্রেন পার হলো,পাম্পে পেট্রল নেওয়া হলো। শেষ পর্যন্ত যখন তামারঙা লেকে পৌঁছলাম,যদিও সূর্য অস্ত গেছে,তবু গোধূলির ছটায় জলাভূমির কিছু অংশ লাল হয়ে আছে। দূরের পাহাড়ের প্রতিবিম্ব বিলের জলে। বিরাট জলাভূমির (৪১২ হেক্টর) মাঝখানে ঝাঁ চকচকে মসৃণ রাস্তা,হেঁটে হেঁটে দুই পাশের জলাশয়ের ভিন্ন রূপ দেখার মজাই আলাদা। জায়াগাটা এক কথায় অপূর্ব। স্থানীয় লোকজনের কাছে শুনলাম আর একটু এগোলেই পাহাড়ের বুকে ঝোরা,কমলা লেবুর গাছ/বাগান দেখা যাবে। ততক্ষণে চারদিক অন্ধকার,তাই আর এগিয়ে লাভ নেই বলে আমরা ফিরে চললাম বঙ্গাইগাঁও। দুপুরে গেলেফু থেকে ফেরার সময় একটু হতাশা ছিল ঠিকই,এখন তামারঙা লেক থেকে ফেরার সময় মন আবার ফুরফুরে….।
আবার বিশ্বনাথ। এবারে গন্তব্য গোয়ালপাড়া এবং শ্রী শ্রী সূর্য পাহাড়…যার ইতিহাস শুরুতেই লিখেছি। অপূর্ব রাস্তা এবং তার দুই পাশের দৃশ্য। দুপাশের সবুজ দেখতে দেখতেই চলে আসে যোগীঘোপা,বঙ্গাইগাঁও জেলার শেষ জনপদ,সামনেই বিশাল ব্রহ্মপুত্র,তার ওপর নর নারায়ণ সেতু। ডবল ডেক ব্রীজ,নীচে রেল লাইন,ওপরে সড়ক। এই ধরণের ডবল ডেক ব্রীজ চর্মচক্ষে দেখা আমার এই প্রথম। আমি বরাবরই অপু,সবকিছুই হাঁ হয়ে দেখি। উত্তর দক্ষিণ বরাবর এই সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই কিলোমিটার,১৯৯৮ এ নির্মিত। নদী পেরিয়ে গেলেই গোয়ালপাড়া জেলা শুরু। গাড়ি সামনে সেতু পার হয়ে এগিয়ে চলেছে আর আমি কয়েক শত বছর পিছনে চলেছি নর নারায়ণের খোঁজে। ১৪৯৮,গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শা কামতা রাজ্যের রাজা নীলাম্বরকে পরাজিত করে নিজ পুত্র দানিয়েলকে এই অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কামতাপুরের পূর্বে তখন বার ভুঁইঞাদের দাপট। বার ভুঁইঞারা হারূপ নারায়ণের নেতৃত্বে দানিয়েল কে পরাজিত ও হত্যা করে এই অঞ্চল অধিকার করে। চিকনা গ্রামের (কোকরাঝাড়) মেচ জনগোষ্ঠীর নেতা হাড়িয়া মন্ডল কোচদের নেতা হাজোর কন্যা হীরা কে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই পুত্র শিশু ও বিশু। বিশু পরবর্তী সময়ে কোচ,মেচ,গারো,মঙ্গোলিয়ান ও দ্রাবিড়িয়ান জনগোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করে ১৫০৯ থেকে ১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বার ভুঁইঞাদের পরাজিত করে কামতাপুরে কোচ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন ও নিজে বিশ্ব সিংহ নামে পরিচিত হন।
বিশ্বসিংহের মৃত্যুর পরে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নর নারায়ণ কামতাপুর রাজ্যের রাজা হন এবং তাঁর আমলে কামতাপুর রাজ্য খ্যাতির শিখরে পৌঁছয়। তাঁর ভাই ও সেনাপতি শুক্লধ্বজ যিনি চিলারায় নামেই বেশি পরিচিত,সমগ্র গোয়ালপাড়া অঞ্চল এবং খাসপুর জয় করেছিলেন। খাসপুরে (কাছাড়) তাঁদের আরেক ভাই কমল নারায়ণ রাজা হন। গোয়ালপাড়া অঞ্চল কামতাপুরের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে নর নারায়ণের মৃত্যুর পর কামতাপুর কোচবিহার ও কোচহাজো এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। চিলারায়ের পুত্র (চিলারায়ের আগেই মৃত্যু হয়েছিল) রঘুদেব গোয়ালপাড়া অঞ্চল,যা পরিচিত ছিল কোচ হাজো নামে তার রাজা হন। নর নারায়ণের পুত্র জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ কোচবিহারের রাজা হন। কোচবিহার রাজ্য মুঘল ও বৃটিশ শাসনে করদ রাজ্য ছিল এবং ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই বংশের শাসনাধীন ছিল। কোচ হাজো বিভিন্ন কারণে ও অসংখ্য যুদ্ধের ফলে আরও কতগুলো ভাগে ভাগ হয়ে যায়..দরং,বেলতলা,বিজনী এবং চিলারায়ের বংশধরেরা শাসন করতে থাকেন। খুব সম্ভবত অভয়াপুরীর রাজবাড়ি চিলারায়ের কোন বংশধরের।
নর নারায়ণ সেতু পার হয়েই গাড়ি হাইওয়ে ছেড়ে অন্য রাস্তা ধরে আমাদের নিয়ে চললো গোয়ালপাড়া। একপাশে বিশাল ব্রহ্মপুত্র,অন্য পাশে জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়…রাস্তার সৌন্দর্য লিখে বোঝানো অসম্ভব,দুচোখ ভরে শুধু দেখার। যদিও তখন দুপুর,আকাশে প্রবল তেজে স্বমহিমায় সূর্য..তবু একজায়গায় ক্ষণিকের বিরতি…ফোটো তোলার জন্য। মহাবাহু ব্রহ্মপুত্রের ঘোলা জল,দূরে নর নারায়ণ সেতু,ওপারে ছোট ছোট পাহাড়ের সারি….এই অতি সুন্দর ও বিশাল প্রকৃতিকে মোবাইলে ধরে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস। দুই চোখ ভরে দেখে,প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে আবার যাত্রা শুরু গোয়ালপাড়া শহর হয়ে শ্রী শ্রী সূর্য পাহাড়। একটি নাতিউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চূড়া অবধি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হিন্দু (শৈব),বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের নানা চিহ্ন…শিব লিঙ্গ,বৌদ্ধ স্তুপ ও বিহারের ধ্বংসাবশেষ,জৈন গুহা। আছে সূর্য মন্দির। উপমহাদেশের তিন প্রাচীন ও প্রধান ধর্মের অষ্টম ও নবম শতাব্দীর নানা নিদর্শন বুকে নিয়ে সূর্য পাহাড় গোয়ালপাড়া তথা আসামের ইতিহাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হওয়ার সম্ভাবনা। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখতে অনেকটা সময় লাগে,শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষাও হয়ে যায়। ক্লান্ত শরীরে তৃপ্ত মনে যখন বঙ্গাইগাঁওয়ের দিকে ফিরছি,সূর্য পাহাড়ের আড়ালে সূর্য তখন অস্তাচলে…।
বৃটিশ আমল থেকে ধুবড়ি,পূর্বতন গোয়ালপাড়া জেলার সদর শহর। বর্তমানে গোয়ালপাড়া ভাগ হয়ে পাঁচটি জেলায় বিভক্ত হয়েছে (গোয়ালপাড়া,ধুবড়ি,কোকরাঝাড়,চিরাং ও বঙ্গাইগাঁও)। এছাড়াও এই অঞ্চলে আছে বিজনী ও বিলাসী পাড়া। ধুবড়ি শহরের তিনদিকেই জল,গদাধর ও সুবিশাল ব্রহ্মপুত্র। নিউ বঙ্গাইগাঁও থেকে গাড়িতে ধুবড়ি,NH ধরে ঘন্টা দুই আড়াই এর এক অপূর্ব যাত্রাপথ এত চমৎকার রাস্তা,দুপাশে সবুজ,শুধু সবুজ…মাঝে মাঝেই ছোট ছোট টিলার সারি,সেগুলোও ঘন সবুজে মোড়া। চাপড় পেরিয়ে এক জায়গায় দেখি রাস্তার দুপাশে শাল গাছের জঙ্গল। একে একে পেরিয়ে এলাম চম্পা,গৌরাঙ্গ,টিপকাই ও গদাধর নদী। দূরে টিলার সারি দেখা যাচ্ছে যার ওপারেই চোখে না পড়লেও,মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র। গদাধর অবশ্য রাস্তার সমান্তরালে শেষ অবধি আমাদের সঙ্গেই চললো,তার যাত্রাপথ শেষ হয় ধুবড়ি শহরের শেষে ব্রহ্মপুত্রের বুকে। বা ধুবড়ি শহরের শুরুতেও বলা যায়,আগে যখন নদী পথই প্রধান পথ ছিল তখন এখান থেকেই শহরের শুরু হয়েছিল,ডিসি র বাংলো,এস পি র বাংলো এবং তাদের অফিস,সার্কিট হাউস সব এখানেই। আমরা হোটেলে (Hotel Swagat) চেক ইন করে প্রায় বিকালে লাঞ্চ সেরেই বেরিয়ে পড়ি ব্রহ্মপুত্র নদের সন্ধানে। খোঁজ খবর করে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম নেতাই ধুবুনী ঘাটে।
এই নেতাই ধুবুনী বা নেতাই ধোপানী বেহুলাকে পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। সুন্দর বনেও দেখেছি নেতা ধোপানী। মালদায় বেহুলা নামে একটা নদী ছিল,এখন প্রায় মজে গেছে। হয়তো অবিভক্ত বাংলা ও সংলগ্ন আসামে আরও অনেক বেহুলা,চাঁদ সদাগর ও নেতা ধোপানীর সন্ধান পাওয়া যাবে,পৌরাণিক কাহিনীর এই এক মজা,কোন তথ্য প্রমাণ নেই,শুধু বিশ্বাসে মিলায় বস্তু…..| প্রচলিত মত অনুযায়ী এই নেতাই ধুবুনী থেকেই স্থানটির ধুবুরী বা ধুবড়ি নামকরণ। ঘাটে বসে বেশ চওড়া জলরাশি দেখছি আর ভাবছি ব্রহ্মপুত্রের স্রোত যেন খুব কম। শেষে স্থানীয় এক মাঝির সাথে কথা বলে বুঝলাম এ নদী সে নদী নয়…এ গদাধর,আরও একটু বেঁকে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে মিশেছে। তার সঙ্গে দরাদরি সেরে বসে পড়লাম ভুটভুটিতে। ভুটভুটি চললো ব্রহ্মপুত্রে…আমরা রোমাঞ্চিত। নদী থেকে ধুবড়ি শহর দেখা,গুরু তেগ বাহাদুর সাহিব গুরুদোয়ারার সুউচ্চ চূড়া,ধুবড়ি পোর্টের ছোট তোরণ,দুপুরের দমকা ঝড়ে উল্টে যাওয়া নৌকা,নদীর বুকে ও তীরে বেশ কিছু জাহাজ….বেশ কিছুটা দূরে নির্মীয়মান সেতু যা আসামের ধুবড়ি ও মেঘালয়ের তুরাকে সংযুক্ত করবে (নির্মাণ শেষ হলে এটি হয়তো ভারতের দীর্ঘতম সেতু হবে) চোখে পড়ে। ব্রহ্মপুত্র দেখা হলো বটে,আশ মেটে না। তবু অন্ধকার হয়ে আসছে বলে তাড়াতাড়ি ফিরতে হচ্ছে।
ফেরার পথে গুরুদোয়ারায় ঢুঁ মারতেই হয়। পাঞ্জাব থেকে এতদূরে ধুবড়ি বা ধুবুরীর মতো ছোট ও প্রান্তিক শহরে এত বড় গুরুদোয়ারা দেখে অবাক লাগে। শিখ ধর্মের নবম গুরু তেগ বাহাদুর ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে এখানে এসেছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব রাজা রাম সিং কে বাংলা মুলুকে পাঠিয়েছিলেন অহোম বিজয়ে। শিবাজী এই রাজা রাম সিং এর অধীনে বন্দী অবস্থায় আগ্রা দুর্গ থেকে পালিয়েছিলেন তাই আওরঙ্গজেব অখুশি হয়ে শাস্তি স্বরূপ রাম সিং কে সুদূর আসাম অভিযানে পাঠান। রাম সিং আসামের তন্ত্র ও ডাকিনী বিদ্যা সম্পর্কে ভীত ছিলেন, তাই গুরু তেগ বাহাদুর কে সঙ্গে নিয়ে আসেন ওই ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রশমিত করার জন্য। গুরুর কাছে আসামের মহিলাদের যাদু কাজ করে না। ফলে সম্রাটের সৈন্যদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে,অন্য দিকে সম্রাটের বিশাল সেনাবাহিনী দেখে অহোম রাজা চক্রধ্বজের আত্মবিশ্বাস কমে। শেষ পর্যন্ত গুরুর চেষ্টায় যুদ্ধ এড়িয়ে সম্রাটের প্রতিনিধির সঙ্গে অহোম রাজার সম্মানজনক সন্ধি হয়। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দুই বাহিনীর সৈন্যরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গুরুদোয়ারার নির্মাণ শুরু করে। ইতিহাস বড় বিচিত্র ও নিষ্ঠুর…১৬৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে দিল্লিতে গুরু তেগ বাহাদুরকে মুন্ডচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে গুরু তেগ বাহাদুরের নির্মম হত্যাকান্ডর প্রতিবাদে ধুবড়ির এই গুরুদোয়ারায় শিখ,হিন্দু, মুসলিম মিলে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
ধুবড়ি আসার পথে দশ কিমি আগে পড়ে গৌরীপুর,জাতীয় সড়কের ধারে। গৌরীপুরে জাতীয় সড়ক থেকে একটা রাস্তা বেরিয়ে ধুবড়িতে আসে। গৌরীপুর ছোট জনপদ কিন্তু রাস্তা গুলো বেশ প্রশস্ত। এই গৌরীপুরের কাছেই ধুবড়ি ও কোকরাঝাড়ের একমাত্র এয়ার পোর্ট,রূপসা এয়ারপোর্ট। বিশ্বযুদ্ধের সময় আর পাঁচটা বিমান বন্দরের মতো এটিও তৈরি করে আমেরিকান সৈন্যরা। স্বাধীনতা লাভের পর কিছুদিন এখানে বিমান ওঠানামা করলেও বেশ কয়েক বছর আগে তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন আবার ধীরে ধীরে বিমানবন্দর চালু করার চেষ্টা চলছে। নন্দলালের পরেই মন্দ কপাল আমার,বিমানবন্দরের গেটে এসে ফিরে যেতে হলো,আপাতত কয়েক দিন এয়ারপোর্টের গেট বন্ধ। গৌরীপুরে রাজ আমলের কাটানো বর্গাকার একটা বড় পুকুরের চারপাশে রাস্তা,গৌরীপুরের হার্ট বলা যায়। একদিকের মাঝামাঝি ঘোড়ায় চড়ে তরবারি হাতে চিলারায়। ধুবড়িতেও ঘোড়ায় চড়ে চিলারায় নদীতীরে একটি পার্কে অপেক্ষা করছেন। তিনি যে এই অঞ্চল জয় করেছিলেন এবং তাঁর বংশধরেরা যে কোচ হাজো দীর্ঘদিন শাসন করেছিলেন,এগুলো তারই সাক্ষ্য বহন করে।
গৌরীপুরে আরেকজনের কথা না বললে এই লেখা অপূর্ণ রয়ে যাবে। তিনি গৌরীপুর থেকে সারা ভারত জয় করেছিলেন,তরবারি দিয়ে নয়,তাঁর অসাধারণ প্রতিভা দিয়ে। তাঁর নাম….শ্রী প্রমথেশ বড়ুয়া। একটি টিলার উপরে তাঁদের মাতিয়াবাগ প্যালেস। টিলার নাম মাতিয়াবাগ হিল,সেই থেকেই প্রাসাদের নাম। প্রাসাদটি গৌরীপুর রাজবাড়ি নামেও পরিচিত। এই প্রাসাদেই বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা ও পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া এবং তাঁর ভাইঝি প্রখ্যাত লোক সংগীত গায়িকা ও কবি প্রতিমা বড়ুয়া পান্ডে থেকেছেন,গদাধর নদীর ধারে নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। তবে তাঁদের বাড়ি এখনও মিউজিয়াম হয় নি,এখনও এই বাড়িতে লোকে বাস করছে। দুয়ার বন্ধ,তাই দূর থেকে কয়েকটা ছবি তুলেই ফিরে আসতে হলো। ধুবড়ি থেকে ৩০ কিমি পূর্বে বা গৌরীপুর থেকে ২০ কিমি পূর্বে এবং বিলাসিপাড়া থেকে ১০ পশ্চিমে মহামায়া মন্দির,অন্যতম সতী পীঠ। কামরূপ কামাখ্যার পর পূণ্যার্থীদের কাছে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আকর্ষণ।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য তুরা,মেঘালয়ের অন্যতম শহর। বঙ্গাইগাঁও থেকে পাইকান তেনালি (তিন মাথা মোড়) ৬৫,পাইকান তেনালি থেকে তুরার দূরত্ব ১০০ কিমি। পাইকানে চা ও জলযোগ সেরে আবার রওনা। এতক্ষণ রাস্তা ও দুপাশের দৃশ্য ছিল বেশ সুন্দর,এবারে….অসাধারণ। পাইকান থেকে ২২ কিমি পরেই আসাম শেষ হয়ে মেঘালয় রাজ্যের অপূর্ব পাহাড়ি পথের শুরু। আমরা মেঘালয়ের পশ্চিম প্রান্ত বরাবর চলেছি গারো পাহাড় শ্রেণীর আঁকা বাঁকা পথ ধরে। গারো পাহাড় শ্রেণীর সর্বোচ্চ পাহাড় Nockrek Peak,উচ্চতা ১৪১২। ওখানে National Citrus Gene Sanctuary cum Biosphere Reserve আছে। তুরার কমলা লেবু,আনারস ও কলা বেশ উৎকৃষ্ট মানের। তুরা ওয়েস্ট গারো হিলসের সদর শহর,গারো পাহাড়ের অধিবাসীরা গারো উপজাতীয় এবং তাদের কথ্য ভাষা গারো। পাইকান থেকে ছোট ছোট কয়েকটি জনপদ (Jengjal,Rongram…) পেরিয়ে তুরা পৌঁছাতে ঘন্টা তিনেক সময় লাগে। তুরা প্রায় ৩৫০ মিটার উচ্চতায় অত্যন্ত আরামদায়ক আবহাওয়ার এক ছোট পার্বত্য শহর। ভারতের প্রাক্তন স্পীকার প্রয়াত P A Sangma র বাড়ি তুরা শহরে।
তুরা পিক এর উচ্চতা ৮৭২ মিটার,তুরা শহরের লোকজনের এক অতি প্রিয় ট্রেক রুট ৷ বৃষ্টি বহুল এই পাহাড়ি এলাকায় ছোটবড় অনেক জলপ্রপাত ও ঝর্ণা আছে। এ’রকম এক সুন্দর জলপ্রপাত,তুরা থেকে ৭-৮ কিমি দূরের Pelga waterfalls,এই ভরা বর্ষায় তার অপূর্ব রূপ দেখে মন ভরে যায়। মাছ ধরার নেশা আছে যাদের তারা এখানে পাথরের ওপর ছিপ হাতে বসে, শুয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারেন। জলপ্রপাতের পেছনে রয়েছে লোহার তার ও বাঁশের তৈরি একটি ঝোলানো সেতু,হেঁটে পারাপারের জন্য। Pelga থেকে ফেরার পথে নিউ তুরার Dakopgree তে চা পানের জন্য একটা দোকানে বসি। উল্টো দিকে একটা স্টেডিয়ামের নির্মাণ চলছে,লোহার তৈরি স্টেডিয়াম,ন্যাশানাল গেমস এর দায়িত্ব পেয়েছে মেঘালয়,তারই প্রস্তুতি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অস্তগামী সূর্যের ছটায় রঙীন আকাশ দেখতে দেখতে আপন মনে গুনগুন করছি ,”আকাশে আজ রং এর খেলা,মনে মেঘের মেলা…”, সামনেই আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ বাণী তুরার টাওয়ার।
পরদিন মীর জুমলার সমাধি। তুরা থেকে পার্বত্য পথ ধরে নেমে গারোবাধা হয়ে মানকাছাড় যাওয়ার পথে ঠাকুরণবাড়ির কাছে একটা ছোট উঁচু ঢিবির ওপরে মীর জুমলার সমাধি। ইরানের গরীব ঘরের সন্তান,ভাগ্যান্বেষণে গোলকুন্ডায় এসে হীরা সহ অন্যান্য মূল্যবান বস্তুর ব্যবসা করে অনেক সম্পদের মালিক,গোলকুন্ডার উজির,মোগল শাহজাদা আওরঙ্গজেব ও বাদশা শাহজাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের আস্থাভাজন হওয়া…ইতিহাসের বর্ণময় এক চরিত্র মীর জুমলা। ১৬৫৯ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে সুবে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ১৬৬৩ সালে ঢাকা থেকে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে ধুবড়ি হয়ে কোচবিহার,কোচ হাজো,কামরূপ দখল করে,অহোম রাজাকে চুক্তি করতে বাধ্য করে ফেরার পথে এই স্থানে তাঁর মৃত্যু হয় এবং এখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। মসজিদ,সমাধি,বাঁধানো বিশাল চত্বর (ঈদ গা ময়দান),প্রচুর আম গাছ…সব মিলিয়ে জায়গাটা চমৎকার। একটি ছোট্ট নদী পটে আঁকা ছবির মতোই বয়ে যাচ্ছে,সামান্য দূরেই বাংলাদেশ। এখন এই জায়গা মীর জুমলা নামেই পরিচিত। পাশেই আরেকটি ঢিবির ওপরে একটি ছোট মন্দির,কামাখ্যা মন্দির। কামরূপ ছাড়া আর কোথাও যে কামাখ্যা মন্দির আছে তা আগে জানা ছিল না। সত্য মিথ্যা জানি না,স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস এটিও এক সতী পীঠ,এখানে সতীর হাতের আঙ্গুল পড়েছিল। কথাতেই আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর….।
***************************************
সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় পরিচিতিঃ জন্ম ১৯৬৬ সালে। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং কৃষি বিদ্যায় স্নাতক। বর্তমানে এল আই সি তে কর্মরত। সখ বেড়ানো ও লেখা।